নারায়ণগঞ্জে টিসিবি পণ্য নিয়ে ভোগান্তিতে হাজারো মানুষ
রাজু আহমেদ, নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশ: ০৩ এপ্রিল ২০২৩, ১০:৪২ পিএম
এ যেন গরিবের মুরগিতে শকুনের থাবার মতো অবস্থা। নারায়ণগঞ্জে টিসিবি পণ্য নিয়ে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নিম্নআয়ের হাজার হাজার মানুষের। পবিত্র রমজানে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়েও পণ্য নিতে ব্যর্থ হচ্ছেন অগণিত মানুষ। টিসিবির পণ্য না কিনেই ভোক্তাকে শুনতে হচ্ছে ‘এই কার্ডে মালামাল আগেই কেনা হয়ে গেছে’। ফলে হাজার হাজার কার্ডধারীকে দিনভর লাইনে থাকার পরেও ফিরে যেতে হচ্ছে শূন্যহাতে।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে টিসিবি পণ্য সংগ্রহে গ্রাহকদের ভোগান্তি কমাতে ‘হাতের মুঠোয় টিসিবি পণ্য’ অ্যাপস ও স্মার্ট কার্ড চালু করলেও সেখানে যেন বিপত্তি আরও অনেক বেশি।
নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন এলাকাসহ পুরো জেলায় দুই লাখ এক হাজার ৪২০টি স্মার্টকার্ড দেওয়া হলেও তার মধ্যে প্রায় ৩০ হাজার কার্ডই ডুপ্লেক্স বা ভুল হয়েছে; যেগুলো ইতোমধ্যেই বাতিল করেছে জেলা প্রশাসন।
একদিকে শত শত ভোক্তা ও জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ ডিলারের কাছ থেকে নেয়া পণ্যের প্যাকেটে ওজনে কম দেওয়া হচ্ছে। অপরদিকে ডিলাররা অভিযোগ করছেন, সরকার থেকে প্যাকেটজাত পণ্য দেয়ার কথা থাকলেও তাদেরকে খাদ্য গুদাম থেকেই বস্তাজাত পণ্য দেয়া হচ্ছে এবং ডিলারদের কোনো লেবার কষ্ট (প্যাকেটকারী শ্রমিকদের পারিশ্রমিক) দিচ্ছে না জেলা প্রশাসন। ফলে সময়ের অপচয়ের সঙ্গে সঙ্গে ডিলারদের কস্টিং অনেক বেশি পরছে।
গত এক সপ্তাহে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে ঘুরে পাওয়া গেছে সাধারণ মানুষের চরম ভোগান্তির চিত্র। নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তদের জন্য ভর্তুকি মূল্যে নিত্যপণ্য বিক্রয়ের সরকারের এই মহতী কর্মসূচি ম্লান হয়ে যাচ্ছে নানা জটিলতা আর মধ্যস্বত্বভোগীদের জালিয়াতির কারণে।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়েও কোনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই মালামাল দেওয়া হয়নি এমন ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়া রাতে কার্ড পাওয়ার পর সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়েও অনেককে শুনতে হয়েছে তিনি মাল আগেই নিয়ে গেছেন, এমনটাই বলছে স্মার্ট কার্ডের অ্যাপস বা সফটওয়্যার। এছাড়াও যারা পণ্য ক্রয় করেছেন তাদের বেশির ভাগেরই অভিযোগ প্রতি প্যাকেটে ওজনে কম দেওয়া হচ্ছে ৫০ থেকে ১০০ গ্রাম পর্যন্ত।
এসব ব্যাপারে জেলা প্রশাসক মঞ্জুরুল হাফিজ জানান, অনেক সময় টিসিবির মালামাল নিতে গ্রাহকদের অনেক ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছে। যা মানুষের মাঝে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে আমরা একটি সফটওয়ার ডেভেলপ করার চিন্তা করি। তিন দিনের মাথায় আমাদের এই কাজ শেষ হয়। গত বছর আমরা ইলেক্ট্রনিক্স কার্ডের মাধ্যমে টিসিবি পণ্য বিক্রি করা শুরু করি। পর্যায়ক্রমে চাহিদার ভিত্তিতে সফটওয়ারটি আরও ডেভলপ করা হয়। মানুষের এই পবিত্র আমানত আমরা অন্যের হাতে চলে যাক তা চাই না। এ কারণে প্রতিটি ওয়ার্ড শতভাগ ডিজিটাল কার্ড না হওয়া পর্যন্ত মাঝে আমরা টিসিবি পণ্য বিতরণ বন্ধও রেখেছিলাম।
তিনি জানান, এমনও হয়েছে- একই ব্যক্তি দুইবার নাম ঠিকানা একটু এদিক সেদিক করে টিসিবি কার্ড পেয়েছে দুইটি। এমন ডুপ্লেক্স কার্ড আমরা চিহ্নিত করেছি প্রায় ৩২ হাজারের মতো। এগুলো বাতিল করা হয়েছে। ম্যানুয়াল কার্ড দিয়ে এই ফাঁকিবাজি ধরা মুশকিল।
পণ্য না কিনতেই ভোক্তাকে জানানো হচ্ছে তিনি পণ্য নিয়েছেন আগেই, এমন ক্রুটির ব্যাপারে ডিসি মঞ্জরুল হাফিজ আরও বলেন, কম্পিউটার বা সফটওয়্যার ভুল করতে পারে না। যারা কার্ড বিতরণ করেছেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ আগেই কার্ড পাঞ্চ করেছেন অর্থাৎ সেই পণ্য ভোগ করেছেন, রেখে দিয়েছেন বা বিক্রি করেছেন। ফলে জালিয়াতি শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
তিনি বলেন, সিটি করপোরেশনের একটি ওয়ার্ডের কাউন্সিলর প্রায় ৬শর উপরে কার্ড আগেই ভোক্তাদের না দিয়ে পাঞ্চ করেছেন। আমরা তাকে ডেকেছিলাম, তিনি দুঃখ প্রকাশ করে ভুল স্বীকার করেছেন। আমরা জানতে পেরেছি এই ৬শ মালামালের মধ্যে তিনি, তার লোকজন ও ডিলারের লোকজনের মধ্যে ভাগাভাগি হয়েছে।
এদিকে জেলা প্রশাসক ওই কাউন্সিলরের নাম না বললেও যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে তিনি নাসিকের ২৭নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সিরাজুল ইসলাম। এ ব্যাপারে তাকে ফোন করলে বিষয়টির সত্যতার প্রমাণ মিলে।
তবে কাউন্সিলর সিরাজ জেলা প্রশাসক অফিসে যাওয়ার কথা স্বীকার করলেও ভুল স্বীকার করার বিষয়টি অস্বীকার করে জানিয়েছেন, আমি কোনো ভুল করিনি। প্রকৃতপক্ষে আমার এলাকার টিসিবি ডিলার এই কাজটি করে উল্টো জেলা প্রশাসকের কাছে বিচার দিয়েছেন। জেলা প্রশাসক না জেনে মিথ্যা কথা বলছেন।
এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, সফটওয়ারের দোষ এখন চাপানো হচ্ছে কাউন্সিলরদের ওপর। আমরা কার্ড পাঞ্চ করেছি নাকি পাঞ্চ করা কার্ড আমাদের দেওয়া হয়েছে সেটার প্রমাণ কী। এমনও তো হতে পারে জেলা প্রশাসনের কোনো চক্র এই ৩০ হাজার ডুপ্লেক্স কার্ড ও পাঞ্চ করা কার্ডের ঘটনা ঘটিয়েছে। হতে পারে শর্ষের মধ্যেও ভূত লুকিয়ে আছে।
নগরীর ১২নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শওকত হাশেম শকু জানান, গত ২৯ মার্চ প্রশাসনের দেওয়া রোস্টার অনুযায়ী আমার এখানে দেড় হাজার ভোক্তা সারাদিন লাইনে ছিলেন পণ্য নেওয়ার জন্য। কিন্তু হুট করেই মাল নিয়ে ডিলার চলে গেলেন, জানানো হলো ডিসি অফিসের নিষেধ, মাল আজকে দেয়া হবে না। এখন এই দেড় হাজার মানুষের দুর্ভোগ এর জবাব কে দিবে? মানুষের ক্ষোভ গেল সরকারের ওপর।
শওকত হাশেম জানান, আমি কার্ড বিলি করলাম রাতে আর সকালে সেই কার্ডধারীকে বলা হলো তিনি নাকি আগেই মাল নিয়ে গেছেন। এখন ওই পণ্য কে নিয়েছে না এটা প্রযুক্তিগত ভুল হচ্ছে সেই জবাব কে দিবে?
এদিকে ডিলারের কাছ থেকে কেনা টিসিবির পণ্যে ওজনে কম দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে হাজার হাজার। জানা গেছে, টিসিবির পণ্য প্যাকেটজাত করে দেওয়ার নিয়ম থাকলেও ডিলারদের সেই প্যাকেট করতে হচ্ছে।
এ ব্যাপারে টিসিবির মুখপাত্র যুগ্ম পরিচালক (ঢাকা বিভাগীয় প্রধান) হুমায়ন কবীর জানান, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমরা প্যাকেটজাত পণ্য কিনে থাকি। যেগুলো কিনতে পারি না সেগুলো বস্তা কেনা হয়। কারণ বেশিরভাগ প্যাকেটজাত মালামালের ক্ষেত্রে সরবরাহকারীরা সময়মতো সরবরাহ করতে পারে না। তাই আমরা দ্রুত পণ্য দেওয়ার জন্য বস্তাজাত পণ্য কিনি। প্যাকেটিং এর জন্য গত ২-৩ মাসে আমরা প্যাকেটিংয়ের কোনো টাকা দিচ্ছি না। আমরা টাকা দিলেই কেবল জেলা প্রশাসক প্যাকেটিং চার্জ দিতে পারবেন, না দিলে সেটা সম্ভবপর নয়।
অপরদিকে ওজনে কম দেওয়ার ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসক জানিয়েছেন, কোনো ডিলারের মালামালে যদি এক ফোটাও পরিমাণে কম পাওয়া যায় তবে তার ডিলারশিপ বাতিল করা হবে। তিনি বলেন, ৩০ থেকে ৩২ হাজার কার্ড বাতিল হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের প্রায় এক লাখ ৭০ হাজার মানুষের কাছে এই কার্ড রয়েছে। বাকি কার্ডগুলো তৈরি হচ্ছে। ঈদের আগে দ্বিতীয় দফায় টিসিবি পণ্য মানুষের কাছে পৌঁছে দেব।