অগ্রণী ব্যাংকের এক কোটি ৮০ লাখ টাকার ঋণ জালিয়াতি, তদন্ত প্রতিবেদন
শাহরিয়ার আলম সোহাগ, কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ)
প্রকাশ: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ০৪:৩৩ এএম
ছবি: যুগান্তর
অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেডের অডিট অ্যান্ড ইন্সপেকশন ডিভিশন ১-এর ২৬তম অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে তাদের দোষী সাব্যস্ত করে তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়া হয়েছে। তবে এখনও তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করা হয়নি।
২৩৮ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে কালীগঞ্জ অগ্রণী ব্যাংকের লুটপাটের ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে।
অডিট রিপোর্টে গ্রাহক ও ব্যাংকের অর্থ তছরুপের সঙ্গে যাদের দায়ী করা হয়েছে, তারা হলেন– সাবেক বরখাস্তকৃত শাখা ব্যবস্থাপক শৈলেন বিশ্বাস, ক্যাশ অফিসার আব্দুস সালাম ওরফে বাইট্টা সালাম ওরফে সুদিপ্ত সালাম, বর্তমান ইবি শাখার প্রিন্সিপাল অফিসার কামরুজ্জামান ও অস্থায়ী মাঠ সহকারী আজির আলী।
জানা যায়, গত বছর অক্টোবর মাসে কালীগঞ্জ অগ্রণী ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির খবর পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হলে সাময়িকভাবে ম্যানেজার ও ক্যাশ অফিসারসহ তিনজনকে বরখাস্ত করে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে হেড অফিস।
এর পর পাঁচজনকে সদস্য করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত কমিটির প্রধান নিযুক্ত হন হেড অফিসের সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার জাকারিয়া মণ্ডল।
এ ছাড়া তদন্ত টিমে প্রধান অফিসের এসও অডিটর গোবিন্দ চন্দ্র দাস, ফারুক হোসেন, এসপিও সুব্রত কুমার সাহা ও এসও জুলহাস উদ্দীনকে সদস্য করা হয়। ২০২০ সালের ২৫ অক্টোবর তদন্ত কমিটি সরেজমিন তদন্ত শুরু করেন।
তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বরখাস্তকৃত শাখা ব্যবস্থাপক শৈলেন বিশ্বাস, ক্যাশ অফিসার আব্দুস সালাম, বর্তমান ইবি শাখার প্রিন্সিপাল অফিসার কামরুজ্জামান ও মাঠকর্মী আজির আলী ৪১ লাখ ৭৯ হাজার ৯৩১ টাকা ভুয়া ঋণ উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত।
কালীগঞ্জ উপজেলার মৃত আরশেদ আলীর ছেলে হোসেন আলী ২০১৯ সালের ৩ জুলাই ইন্তেকাল করেন। তার নামে ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি ৪৭ হাজার টাকার ঋণ উত্তোলন করা হয়েছে। অস্থায়ী মাঠ সহকারী আজির আলী মৃত হোসেন আলীর বাড়িতে গিয়ে ঋণ গ্রহণের বিষয়ে স্বীকারোক্তি দিতে চাপ প্রয়োগ করেন।
একইভাবে কালীগঞ্জের মৃত মনির উদ্দীন মালিথার নামে ৫০ হাজার টাকা, মনোহরপুর গ্রামের আব্দুল মালেকের নামে ৪৮ হাজার টাকা, আহম্মদ আলীর নামে ৬০ হাজার টাকা ও নিতাই মল্লিকসহ একাধিক মৃত ব্যক্তিদের নামে ২৭ হাজার টাকা ঋণ তুলে পকেটস্থ করেন।
বিদেশে থাকা পুকুরিয়া গ্রামের মনিরুল, নজরুল ইসলাম, টিটো বিশ্বাস, মনোহরপুর গ্রামের ইস্রাফিল, বড়সিমলা গ্রামের শাহিনুর, ছোট সিমলা গ্রামের হায়দার আলী, আব্দুল হামিদ, মধুসুদন, ভারতে চলে যাওয়া অধীর কুমার দাসের নামেও তাদের অজান্তে চার লাখ ৭৬ হাজার ৯৩১ টাকার ঋণ তোলা হয়।
এ ছাড়া মঞ্জুরিকৃত ঋণের চেক গ্রাহককে কম টাকা দিয়ে অবশিষ্ট ১২ লাখ ৬৮ হাজার ৭০০ টাকা আত্মসাৎ করেন। ঋণ হিসাবে কৃষকরা জমা দিলেও প্রতারণা ও জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে তারা দুই লাখ ৭৮ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন।
জাল মাঠ পাড়চা তৈরি করে চক্রটি এক কোটি ২২ লাখ ৬৭ হাজার ৭০৬ টাকার ঋণ দিয়েছেন। আবাদি জমির প্রমাণক গ্রহণ না করে ২৫ লাখ ৬৩ হাজার ৭৯৬ টাকার ঋণ দেন।
তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লিখিত ব্যাংক কর্মকর্তাদের স্বেচ্ছাচারিতা, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির এক ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়। তারা মৃত, বিদেশ থাকা ও নাম-পরিচয়বিহীন অর্ধশত ব্যক্তির নামে ঋণ দিয়ে টাকা আত্মসাৎ করেন। মাঠকর্মী আজির আলী তার ভাই, মামা-ভাবিসহ নিকটাত্মীয়দের নামে ছয় লাখ ৫৮ হাজার টাকার ঋণ গ্রহণ করেন।
ঋণ আদায় করতে গিয়ে আজির আলী কালীগঞ্জের মনোহরপুর গ্রামের কৃষক সিরাজুল ইসলামের গোয়ালের গরু খুলে নিয়ে আসেন। গরু বিক্রি করা হলেও আজির আলী ওই কৃষকের ঋণের টাকা ব্যাংকে জমা দেননি।
এ ছাড়া রোকনপুর গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে কৃষক আক্কাস আলী, পুকুরিয়া গ্রামের জোনাব আলীর ছেলে বাবর আলী ও মনোহরপুর গ্রামের আব্দুস সাত্তার বিশ্বাসের ছেলে ইন্তাজ আলীর নামে ঋণ তুলে তাদের চার লাখ টাকার ভুয়া চেক প্রদান করেন।
তথ্য নিয়ে জানা গেছে, কালীগঞ্জ উপজেলার নিশ্চিন্তপুর গ্রামের জগন্নাথ বিশ্বাসের ছেলে শৈলেন ২০১৭ সালের ১৭ জুলাই শাখা ম্যানেজার পদে যোগ দেন। তার বিরুদ্ধে আগেও নানা অনিয়ম-অভিযোগের তদন্ত হয়েছে।
অন্যদিকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কোঠায় ২০১৭ সালের ৫ অক্টোবর কালীগঞ্জ শাখায় অফিসার ক্যাশ পদে যোগ দেন হরিণাকুণ্ডু উপজেলার ভেড়াখালী গ্রামের আব্দুল গণির ছেলে আবদুস সালাম। তিনি প্রথম বিদ্যুৎ বিল ও ২০১৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঋণ শাখায় যোগদান করেই দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন।
অভিযোগ ওঠে শৈলেন ও সালামকে সঙ্গে করে প্রতারক আজির আলী টাকা আত্মসাতের মিশন নিয়ে মাঠে নামেন। স্থানীয় চক্রের সহযোগিতায় তারা জালিয়াত সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন। কৃষকসহ কাল্পনিক গ্রহীতাদের নামে জাল কাগজপত্র তৈরি করে এবং ভুয়া স্বাক্ষর করে তারা কৃষিঋণ নেন।
জালিয়াতির দায়ে শৈলেন বিশ্বাসকে চুয়াডাঙ্গায় বদলি করা হলে শাখায় নতুন ব্যবস্থাপক হিসেবে যোগ দেন এসপিও নাজমুস সাদাত। তিনি যোগদানের পর বেরিয়ে আসে টাকা আত্মসাতের মহাজালিয়াতির খবর। ব্যাংকের কোটি টাকার ওপরে আর্থিক কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত থাকার পরও সাময়িক বরখাস্ত ছাড়া তাদের বিরুদ্ধে এখনও কোনো মামলা হয়নি বলে অভিযোগ।
তবে অগ্রণী ব্যাংকের খুলনার জিএম ফারুক আহম্মেদ বুধবার বিকালে মোবাইল ফোনে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভাগীয়ভাবে তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। এখন সম্পূরক চার্জশিট প্রদান করবে অডিট বিভাগ।
তিনি বলেন, তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলার বিষয়টি সময়ের ব্যাপার মাত্র। অভিযুক্তরা কোনোভাবেই ছাড় পাবেন না বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এদিকে গত ডিসেম্বরে এ নিয়ে পত্রপত্রিকায় লেখালেখি হলে ঝিনাইদহ থেকে প্রকাশিত দৈনিক নবচিত্র পত্রিকার বার্তাপ্রধান আসিফ কাজল, যুগান্তরের কালীগঞ্জ প্রতিনিধি শাহরিয়ার রহমান সোহাগ ও ব্যাংকের সদ্য যোগদানকৃত ব্যবস্থাপক এসপিও নাজমুস সাদাতের বিরুদ্ধে আব্দুস সালাম ও আজির আলী বাদী হয়ে ঝিনাইদহের একটি আদালতে কথিত মানহানির মামলা করেন।
মামলাটি এখন কালীগঞ্জ থানার এসআই আবুল খায়ের তদন্ত করছেন। সে সময় দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ব্যাংক কর্মচারীদের মামলার প্রতিবাদে ফেটে পড়েন সংবাদকর্মীরা। প্রতিবাদে জেলার ছয় উপজেলার সাংবাদিকরা বিক্ষোভ মিছিল, স্মারকলিপি প্রদান ও মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন।