বাঁধ নির্মাণের দাবিতে যমুনাপাড়ে অনশনে দুই বৃদ্ধ
রফিক মোল্লা, চৌহালী (সিরাজগঞ্জ)
প্রকাশ: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১০:৫২ এএম
‘৮০ বছরের জিন্দিগিতে বাপুরে ৭ বার নদী ভাঙা দিছি। নদী ভাঙতি ভাঙতি সব সম্পত্তি বিরান অইছে। হ্যাস জীবনে আইস্যা ভিটাডা নদীর পাড়ে রইছে। যদি বাড়িই জায়গ্যাই না থাহে বাইচ্যা থাইক্যা কী অইবো। এহুনি বাঁধ না দিলি এই ভিটাই জীবন শেষ কইরা দিমু’- কথাগুলো এভাবেই কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন যমুনার রাক্ষসী থাবায় লণ্ডভণ্ড ঘাটাবাড়ি চরের ইয়াসিন প্রামাণিক।
সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানাধীন আড়কান্দি-পাকুরতলা ও ঘাটাবাড়ি এলাকায় নদী ভাঙনে বিলীন হচ্ছে বসতভিটা ও ফসলি জমি। আর বাঁধ নির্মাণের দাবিতে ঘাটাবাড়ি এলাকায় যমুনার পশ্চিম তীরে বৃদ্ধ ইয়াসিন প্রামাণিক ও রহম আলী মোল্লা অনশন করছেন।
রোববার দুপুরে এ খবর সংগ্রহে সরেজমিন দেখা যায়, ঘাটাবাড়ি এলাকায় যমুনার পশ্চিম তীরে একটি পাটি বিছিয়ে ইয়াসিন প্রামাণিক ও রহম আলী মোল্লা অনশন করছেন। তারা নদী তীরে শুয়ে আছেন।
নদীতে স্থায়ী তীর সংরক্ষণ বাঁধ নির্মাণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের সিনিয়র সচিব এলাকার সন্তান কবির বিন আনোয়ারের দৃষ্টি আকর্ষণে শনিবার থেকে অনশন শুরু করেছেন তারা।
বয়োবৃদ্ধ রহম আলী মোল্লা যুগান্তরকে জানান, কয়েক দিন আগে নদীভাঙন আতঙ্কে ঘরবাড়ি অন্যত্র সরিয়ে নিয়ে রাখা হয়েছে। তবে ভিটামাটির মায়ায় আমার কলিজা ছিঁড়ে যাচ্ছে। নদীতে সব বিলীন হচ্ছে, কেউ আমাদের কাজ করে দিচ্ছে না। দেশের বহু জায়গায় বাঁধ নির্মাণ হচ্ছে কিন্তু পাউবোর সিনিয়র সচিব নিজ জেলার সন্তান হয়েও আমাদের এলাকা রক্ষা করতে পারছে না। এর আগে মন্ত্রী, এমপি ও সচিব সাহেব ভাঙন পরিদর্শনে এসে দ্রুত বাঁধ করে দেয়ার আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিছু জিও ব্যাগও ফেলেছেন। তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না। স্থায়ী কাজের জন্য সাড়ে ৬শ' কোটি টাকার প্রকল্প কবে পাস হবে তা জানি না।
তারা বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের মা আর সচিব সাহেব আমাদের জেলার সন্তান তাদের প্রতি বিশ্বাস আছে। তারা অবশ্যই আমাদের আর্তনাদ শুনলে এলাকা রক্ষায় কাজ করে দেবেন এমন প্রত্যাশায় অনশনে বসেছি। সুখবর না পেলে নদীর পাড়ে নিজ বসত ভিটাতেই পড়ে থাকব। তাতে বাঁচি আর মরি।
এ বিষয়ে বাঐখোলা গ্রামের বাসিন্দা ডা. হাসেম আলী ও সমাজসেবক সামছুল মোল্লা জানান, নদী পাড়ে কিয়ামত শুরু হয়েছে। শত চেষ্টা করেও অনশনকারী দুই বৃদ্ধকে খাবার কিংবা নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া যাচ্ছে না। তারা এলাকা রক্ষায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের সুখবর চায়।
অনশনকারী বৃদ্ধ রহম আলী একটু বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে স্থানীয়রা স্যালাইন দিয়েছে। শুক্রবার হল কোনো খাবার গ্রহণ করছেন না। এলাকাবাসী তাদের নিয়ে উদ্বিগ্ন।
তবে সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে জানান, অনশনকারীদের সঙ্গে আমরা সমব্যথী। তবে সাড়ে ৬ কিলোমিটার এলাকা স্থায়ী রক্ষায় সাড়ে ৬০০ কোটি টাকার প্রকল্পটি অনুমোদনের অপেক্ষাধীন রয়েছে। আশা করছি খুব দ্রুতই সুখবর পাওয়া যাবে।
স্থানীয়রা জানান, এক যুগ ধরে সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানার দক্ষিণে নদীভাঙন চলছে। ভাঙনের কবলে পড়ে বর্তমান নদীর পশ্চিমপাড় ঘাটাবাড়ি থেকে প্রায় ১ কিলোমিটার পূর্বে ছিল উথুলি গ্রাম। প্রতি বছরই নদীতে পানি বৃদ্ধি ও কমার সময় ছাড়াও প্রচণ্ড স্রোতের কারণে একের পর এক বিলীন হয়েছে ব্রাহ্মণগ্রাম, আড়কান্দি, ঘাটাবাড়ি, পাকুরতলা, কুঠিপাড়া, ভেকা ও পাচিল গ্রামের প্রায় সাড়ে ১১ হাজার বসতভিটা।
চৌহালী উপজেলাধীন হাট বয়ড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও বসন্তপুর নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ অন্তত ৮টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ১৪টি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, কবরস্থান, ঈদগাহ মাঠ, তাঁত কারখানাসহ বিস্তীর্ণ ফসলি জমি নদীগর্ভে চলে গেছে। বিশেষ করে এ বছর যমুনা নদীতে দফায় দফায় পানি বৃদ্ধি ও কমতে থাকায় নদীপাড়ে শুরু হয় ভাঙনের রাক্ষসী তাণ্ডবলীলা। এতে বিলীন হয়ে যায় এনায়েতপুর থানার ব্রাহ্মণগ্রাম আড়কান্দি, পাকুরতলা ও ঘাটাবাড়ি এলাকার শতাধিক ঘরবাড়ি ও বহু ফসলি জমি।
এ কারণে নদীর অদূরে থাকা এনায়েতপুর-সিরাজগঞ্জ আঞ্চলিক সড়ক, খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতাল বিশ্ববিদ্যালয়, নার্সিং ইন্সটিটিউট ও দেশের সর্ববৃহৎ এনায়েতপুর কাপড়ের হাটসহ বিভিন্ন স্থাপনা হুমকিতে রয়েছে।