’৭৫-এর স্মৃতিচারণে শামীম ওসমান
শেখ কামাল সেদিন না’গঞ্জে এলে ইতিহাস অন্যরকম হতো
রাজু আহমেদ, নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২০, ১১:২৭ এএম
১৫আগস্ট,৭৫ রাত ১১টায় তোলা শেখ কামালের জীবনের শেষ ছবি। ডান থেকে নাসিম ওসমান, ড. হাসান মামুন, শেখ কামাল, মঈন সিনহা কয়েকজন। ছবি: সংগৃহীত
‘১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট, রাত ১১টা। ঢাকার লেডিস ক্লাবে প্রয়াত জননেতা বড় ভাই নাসিম ওসমানের বিয়ের অনুষ্ঠান চলছিল। বর নাসিম ওসমানের পাশেই বসেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, ড. হাসান মামুন, মঈন সিনহাসহ তাদের বন্ধুদের অনেকেই। এ বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরই সংঘটিত হয়েছিল ইতিহাসের এক কালো অধ্যায়। বাঙালি জাতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে ঘাতকের দল। সেদিন শেখ কামাল নারায়ণগঞ্জে এলেও হয়তো ইতিহাসটা অন্যরকমও হতে পারতো।'
কথাগুলো বলতে বলতে হঠাৎই চোখের কোণে পানি দেখা গেল সেই '৭৫-এর কিশোর বয়সে থাকা বর্তমান সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমানের। ৬ বছর আগে হারিয়েছেন বড় ভাই নাসিম ওসমানকে। আগস্ট এলেই সেসব স্মৃতি যেন তাড়া করে বেড়ায় শামীম ওসমানকে। যুগান্তরের কাছে তুলে ধরেছেন সেই '৭৫-এর ১৪ আগস্ট আর পরবর্তী কিছু ঘটনার স্মৃতি।
শামীম ওসমান বলেন, ‘১৯৭৫ সালে আমার বয়স ১৩ কী ১৪ বছর হবে। বড় ভাই জাতীয় পার্টির সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য নাসিম ওসমানের বিয়ের দিন ছিল ১৪ আগস্ট। ঢাকার একটি কমিউনিটি সেন্টারে চলছিল বিয়ের অনুষ্ঠান। রাতে বিয়ের অনুষ্ঠানে এসেছিলেন প্রয়াত শেখ কামাল ভাই ও তার বন্ধুমহল। স্মৃতিতে যতদূর মনে পড়ে বেশ মজা করছিলেন তারা সবাই। নাসিম ভাইয়ের কাছে শুনেছিলাম, শেখ কামাল ভাই বন্ধুদের বলছিলেন, আগামীকাল (১৫ আগস্ট) বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছেন। সেখানে অনেক কিছুই বলবেন বঙ্গবন্ধু, অনেক কিছুরই খোলাসা হবে।
ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা অনুষ্ঠানের সব আয়োজন সম্পন্ন করেছেন। বিয়ের মঞ্চে বসেই শেখ কামাল ভাইকে রাতেই নারায়ণগঞ্জ যেতে বলেছিলেন নাসিম ওসমান। কারণ পরের দিন ছিল বৌভাতের অনুষ্ঠান। তার বন্ধুরা সবাই যেতে রাজি হলেও শেখ কামাল ভাই শেষপর্যন্ত বলেছিলেন- ‘আমরা গেলে নাসিমের বাসর রাতটাই নষ্ট হয়ে যাবে। কাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুষ্ঠান শেষে সবাই নারায়ণগঞ্জ যাব নাসিমের বৌভাতে।'
শামীম ওসমান স্মৃতিচারণে আরও বলেন, ‘সেদিন শেখ কামাল ভাই নারায়ণগঞ্জে এলে হয়তো ইতিহাসটা অন্যভাবেই লেখা হতো। এ বিষয়টি নিয়ে আমার বাবা বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর সামসুজ্জোহা ও ভাষাসৈনিক মায়ের আমৃত্যু এই কষ্ঠ আর আক্ষেপটা ছিল। কারণ শেখ কামাল ভাইয়ের সাথে তার মুক্তিযোদ্ধা বন্ধুরাসহ ছাত্রলীগের পুরো গ্রুপটাই ছিল। হয়তো ঘাতকরা সেই নারকীয় ঘটনার সাহস করতো না অথবা সেদিন ৩২ নম্বরের বাড়ির পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জের আমাদের পুরো ওসমান পরিবারকেই শেষ করে দিত ঘাতকরা।'
শামীম ওসমান আরও বলেন, ‘খুব সকালেই আমরা জানতে পারি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। ওই সময় কিশোর বয়সে সব কিছু বুঝে উঠতে পারিনি। নবপরিণীতা বধূকে রেখেই আমার ভাবি ও বোনদের সমস্ত সোনার গহনা নিয়ে বড় ভাই নাসিম ওসমান তার কয়েকজন সহযোগীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিশোধ নিতে।’
যতদূর শুনেছি, নাসিম ভাইকে কাছে পেয়ে আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় সাজেদা চৌধুরী আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন। গলা থেকে সোনার চেইন খুলে তিনি নাসিম ভাইকে দিয়ে বলেছিলেন, যা এটা বেচে টাকা জোগাড় কর। নাসিম ওসমানসহ অনেকেই বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিশোধ নিতে কাদেরিয়া বাহিনীতে কয়েক বছর প্রতিরোধ যুদ্ধে ছিলেন।
শামীম ওসমান বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরপরই আমাদের বাসায় একটি ফোন এসেছিল আমার বাবার খোঁজে। বাবা বাসায় নেই শুনে অপরপ্রান্তে থাকা লোকটি নিজেকে খন্দকার মোশতাক পরিচয় দিয়ে আমার মাকে চাইলেন। আমার মায়ের কথোপকথন আমার কানে এখনও বাজে।’
খন্দকার মোশতাক আমার বাবাকে তার মন্ত্রিপরিষদে যোগ দেয়ার অফার দিয়েছিলেন। আমার ভাষাসৈনিক মা নাগিনা জোহা তখন বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর রক্তের উপর দিয়ে আমার স্বামী যদি আপনার মন্ত্রিপরিষদে যোগ দেয় তবে চেষ্টা করব তাকে হত্যা করতে, না হয় তাকে ত্যাগ করতে। এই ফোনালাপের আধাঘণ্টা পরেই আমাদের বাসায় পুলিশের রেইড পড়েছিল।
বাবা একেএম সামসুজ্জোহাকে গ্রেফতার করা হয়। মেজো ভাই সেলিম ওসমানকে (বর্তমানে এমপি) বঙ্গবন্ধুর ঘাতক ক্যাপ্টেন কিসমত হাশেম ও বজলুল হুদা ধরে নিয়ে যায়। আমার মা তখন আমাকে সামনে নিয়ে ওই দুই ঘাতককে বলেছিলেন- আমার আরেকটা ছেলে আছে ওকেও নিয়ে যাও। কারণ বড় হয়ে সেও বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিশোধ নেবে।
মেজো ভাই সেলিম ওসমানকে অকথ্য নির্যাতন করে মৃত ভেবে রাস্তায় ফেলে গিয়েছিল ঘাতকরা।'
শামীম ওসমান বলেন, ‘মায়ের কাছে জানতে চেয়েছিলাম বঙ্গবন্ধু কী? মা বলেছিলেন- বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ। কিশোর বয়সের সেই আমি আর দুই বন্ধু মিলে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার চেয়ে হাতে লেখা পোস্টার নিয়ে সাইকেলে চড়ে দেয়ালে দেয়ালে লাগিয়েছিলাম।
পুলিশ আমাকে মারতে মারতে পিঠের উপর সাইকেল ভেঙেছিল। রক্তাক্ত অবস্থায় এলাকার লোকজন আমাকে উদ্ধার করেছিল।
শামীম ওসমান বলেন, আমরা যারা '৭৫-এর পর রাজনীতিতে এসেছিলাম, তাদের একটাই স্বপ্ন ছিল জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচার হবে। সেই বিচার হয়েছে। এখন এ প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে সেই মহানায়কের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়তে।