বিষমুক্ত আপেলকুলে লাখ লাখ টাকা আয় চাষিদের
রায়হানুল ইসলাম আকন্দ, শ্রীপুর (গাজীপুর) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৮ মার্চ ২০২০, ০২:১৫ পিএম
আপেলকুল। ছবি: যুগান্তর
গাজীপুরের শ্রীপুরে বড়ইবাগান থেকে প্রতি বছর লাখ লাখ টাকা আয় করছেন চাষিরা। বছরের পর বছর ফলন বৃদ্ধি পাওয়ায় অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছেন চাষিরা। স্বাস্থ্যসম্মত এসব বিষমুক্ত নিরাপদ আপেলকুলের চাহিদাও রয়েছে দেশব্যাপী।
স্বাস্থ্য ঝুঁকিমুক্ত বড়ইয়ের চাহিদা থাকায় প্রতি বছরই গাছ ও জমির আয়তন বৃদ্ধি করে বাগান বিস্তৃত করছেন চাষিরা। কেউ শুরু করেছেন মাত্র ১০টি বড়ইগাছ দিয়ে, পরে তা থেকে বৃদ্ধি করে আড়াইশর বেশি গাছ লাগিয়েছেন।
ফুল থেকে ফলে রূপান্তরের কোনো পর্যায়ে বড়ইয়ে বিষ প্রয়োগ করা হয় না বলে জানিয়েছেন চাষিরা। অন্যান্য ফল উৎপাদনের তুলনায় বিষমুক্ত উৎপাদনে বড়ই সেরা হিসেবে দাবি করেছেন চাষিরা।
শ্রীপুর পৌরসভার কেওয়া উত্তরপাড়া গ্রামের জামাল উদ্দিন পাঠান আপেলকুলের চাষ করছেন গত ১০ বছর ধরে। অন্যান্য কৃষিপণ্যের পাশাপাশি তার অন্যতম আয়ের ক্ষেত্র বড়ই (আপলকুল)।
আপেলকুলের চাষ করে তিনি আধাপাকা বসতবাড়ি নির্মাণ, কন্যার বিয়ে দেয়া ও ছেলের পড়াশোনা করানোসহ অর্থনৈতিক সচ্ছলতার মধ্য দিয়ে জীবিকা র্নিবাহ করছেন।
তিনি জানান, গত ১০ বছর আগে একই উপজেলার রাজাবাড়ী এলাকায় এক চাষির বাড়িতে গিয়ে বড়ইয়ের (আপেলকুলের) বাগান দেখতে পান। সেখান থেকেই পরামর্শ ও জাত পরিবর্তনে কলম পদ্ধতি শিখে এসে নিজের জমিতে আপেলকুল চাষের উদ্যোগ নেন।
তিনি প্রথমে জঙ্গলি বা টক জাতের বড়ইয়ের চারা রোপণ করেন। পরে একই বছরে টক জাতের গাছগুলো ছাঁটাই করে দেন।
নতুন শাখা গজানোর পর সেগুলো কলম পদ্ধতিতে আপেলকুলের জাত এনে সংযোগ করেন। এর পর আর পেছন ফেরে তাকাতে হয়নি। যে বছর আপেলকুলের জাত সংযোজন করেন, তার পরের বছর থেকেই ফলন পেতে শুরু করেন। এমনি করে তৃতীয় বছরে ৭০ শতক জমিতে ১৬০টি বড়ই গাছ রোপণ করেন।
চতুর্থ বছর থেকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় তার বাগানের বড়ই বিক্রি হয়। পাইকাররা এসে তার বাগান থেকে বড়ই কিনে নিয়ে যায়।
জামাল উদ্দিন জানান, প্রায় প্রতিদিন তিনি কমপক্ষে ৪০-৫০ কেজি বড়ই সংগ্রহ করতে পারেন। একদিন বা দুদিন বিরতি হলে সংগ্রহের পরিমাণ বেড়ে তা ২০০ কেজিও হয়। এ বছর জানুয়ারির শেষের দিকে বড়ই সংগ্রহ শুরু করেন। মার্চ মাসের শেষ পর্যন্ত বড়ই সংগ্রহের আশা রাখেন।
তিনি বলেন, বড়ইয়ের মধ্যে কোনো কীটনাশক প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। ফুল হওয়ার আগে একবার বড়ইগাছ কীটনাশক দিয়ে ভিজিয়ে দেন। আবার ফুল ফোটার আগে একবার কীটনাশক ছিটিয়ে দেন। প্রতি বছর একবার গাছের সব ডালের গোড়া থেকে কেটে দেন। সেখান থেকে শাখা গজিয়ে বড়ইয়ের ফলন হয়।
উপজেলার রাজাবাড়ী গ্রামের চাষি আবুল কাশেম জানান, তিনি প্রায় ১৫ বছর ধরে বড়ইয়ের চাষ করছেন। ৯০ শতকের বেশি জমিতে আপেলকুলের চাষ করে তিনি পুরো বছর পরিবার-পরিজন নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবিকা নির্বাহ করছেন।
তার বাগানে সাধারণত ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জের পাইকাররা এসে আপেলকুল কিনে নিয়ে যান। মাঝেমধ্যে স্থানীয় বাজারেও বিক্রি করতে হয়। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত বড়ই বেচাকেনা চলে। শ্রীপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে পরামর্শ নিয়ে কলম পদ্ধতিতে উন্নত জাত সংযোজনের মাধ্যমে তিনি আপেলকুল চাষ শুরু করেন।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে উন্নত জাত ও কলমের পদ্ধতির প্রশিক্ষণও নিয়েছেন।
পাইকারি ক্রেতা শ্রীপুরের মালিপাড়া গ্রামের জামালউদ্দিন মোল্লা বলেন, বছরের তিন মাসে তিনি কমপক্ষে ৯০ লাখ টাকার বড়ই ক্রয় করে বিক্রি করেন। তিনি সাধারণত ঢাকা বেড়িবাঁধের কামারপাড়া স্লুইসগেট এলাকায় বড়ই বিক্রি করেন। চাষিদের কাছ থেকে ৭০ টাকা কেজি বা চাহিদা মৌসুমে ৮০ টাকা কেজি দরে বড়ই ক্রয় করে থাকেন।
সাম্প্রতিক বছরে মিষ্টি আপেলকুলের পাশাপাশি টক বড়ইয়ের চাহিদাও রয়েছে বলে জানান তিনি। টক বড়ইয়ের চাষ করেছেন চাষিরা। টক বড়ইয়ের পাইকারি মূল্য ৫০ টাকা কেজি।
চাষবাসের প্রক্রিয়া নিয়ে তিনি বলেন, চৈত্র মাসের পর বড়ইগাছের সব ডালপালা কাণ্ড থেকে কেটে ফেলা হয়। নতুন ডালপালা থেকে বড়ইয়ের ফলন হয়। ফল আসার দুই মাস আগে কীটমুক্ত করতে বড়ই গাছে কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। এর পর আর কোনো ওষুধ প্রয়োগ করতে হয় না। ফলে মিষ্টি আপেলকুল নিশ্চিত বিষমুক্ত থাকে।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কামসাইনগরপাড়া এলাকার বড়ইয়ের বেপারি কারি হোসেন বলেন, গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার রাজাবাড়ী বাজারে বড়ইয়ের আমদানি সবচেয়ে বেশি হয়। শ্রীপুরে বড়ইয়ের চাষ বেশি হওয়ায় প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার রাজাবাড়ী বাজারে বড়ই ক্রয় করতে পাইকারদেরও ভিড় জমে।
প্রতি বছর বড়ইয়ের মৌসুমে তিনি ৫০ লাখ টাকার বড়ই কেনাবেচা করেন। প্রতি বছর বড়ই আমদানিও বাড়ে কেনাবেচাও বাড়ে। এ বছর তিনি কমপক্ষে ৭০ লাখ টাকার বড়ই বেচাকেনা করবেন।
শ্রীপুর উপজেলা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা আবু সাঈদ জানান, শ্রীপুরে ছোট-বড় বড়ই বাগানের সংখ্যা এক হাজার ৮৪০টি। গত বছর কুল চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০৫ হেক্টর।
বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ২৩০-এর বেশি। প্রতি হেক্টরে ফলন ছিল ৯ থেকে ১০ টন। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১২ টনে। প্রতি বছর বড়ইয়ের আবাদ বাড়ছে এবং একই সঙ্গে ফলনও বাড়ছে। বর্তমানে এক মৌসুমি ফল হিসেবে বড়ই চাষে শ্রীপুরের চাষিরা অভাবনীয় সফলতার প্রমাণ দেখিয়েছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এসএম মুয়ীদুল হাসান জানান, শ্রীপুরে মৌসুমি ফল চাষের মধ্যে আপেলকুল চাষিদের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। ধানের পর ফল চাষ এই এলাকার অন্যতম কৃষি। চাষিদের মধ্যে মিষ্টি ফল আপেলকুলের অর্থনৈতিক সফলতা সবচেয়ে বেশি।
এই এলাকায় কাঁঠাল ও লিচুর পাশাপাশি বড়ইয়ের অবস্থান রয়েছে। ফলে এ চাষ দ্রুত বিস্তৃতি লাভ করছে। কৃষকদের আরও লাভবান এবং উৎসাহিত করতে নিজেদের মধ্যে বাজার সৃষ্টির চেষ্টা করা হচ্ছে। এতে চাষিরা সরাসরি বড়বাজারে বা আড়তে নিজেরাই বড়ই সরবরাহ করতে পারবে।