ফাহিমা। ছবি: যুগান্তর
কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার রানীগঞ্জ ইউনিয়নের কাঁচকোল বুরুজেরপাড় গ্রামের মানসিক প্রতিবন্ধী ফাহিমা ৩ মাস ধরে শিকলবন্দি জীবন কাটাচ্ছেন।
কাঁচকোল বুরুজেরপাড় গ্রামের ঈমাম মৃত. নুরুজ্জামানের মেয়ে। অভাবের সংসারে ৮ মেয়েসহ ১০ জনের পরিবার। এর মধ্যে ফাহিমা ছিল ৫ম নম্বর মেয়ে। ফাহিমা সাধারণ মানুষেরই মতো স্বাভাবিক জীবনযাপন ছিল তার। মেধাবি শিক্ষার্থী হিসেবে বেশ পরিচিত ছিলেন ফাহিমা।
তিনি কাঁচকল খামার ছকিনা ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসা থেকে ১৯৯৬ সালে দাখিল পরীক্ষায় অংশ নিয়ে দ্বিতীয় বিভাগে পাস করে। আকস্মিকভাবে তার বাবা নুরুজ্জামান পার্যারলাইসিস আক্রান্ত হয়ে পড়েন। একজনের উপার্জনক্ষম সংসারে নেমে আসে অভাব।
সংসার চালাতে ফাহিমা পাড়ি জমান চট্টগ্রামে। সেখানে একটি গার্মেন্টসে চাকরি নেন ফাহিমা। চাকরিরত অবস্থায় এইচএসসিতে ভর্তি হন ফাহিমা। এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে অসধুপায় অবলম্বন করায় তাকে বহিষ্কার করা হয়। তখন থেকেই ভেঙ্গে পড়েন ফাহিমা। পুনরায় চাকরিতে চলে গিয়ে এর কয়েক মাসের মাথায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে থাকেন তিনি।
সরেজমিন দেখা যায়, ব্রহ্মপুত্র নদের পাশেই খড়ের বেড়া বেষ্টিত ভেতরে ছোট্ট একটা টিনের চালায় বসবাস ফাহিমার। বাড়ির ভেতরে খুঁটির সঙ্গে লোহার তালাবন্দি শিকলে বাঁধা ফাহিমা। পায়ের সঙ্গে লাগানো লোহার শিকলই সারা দিন কাটছে ফাহিমার।
শিকলের দাগে পায়ে ক্ষত পড়তে শুরু করেছে। দিন-রাতে সব সময় শিকলবন্দি থাকে ফাহিমা। বাকি বোনদের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় ফাহিমার দিন কাটছে ৬৫ বছর বৃদ্ধ মায়ের সঙ্গে। এই বৃদ্ধ মায়েই তার দেখাশোনা করেন।
ফাহিমার মা রাবেয়া বেগম জানান, জায়গা-জমি সবই ছিল। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনে সব শেষ হয়ে গেছে। ফাহিমার বাবা মসজিদের ঈমামতি করেই সংসার চালাতেন। সে অসুস্থ হওয়ায় ২০১৫ সালে মারা যান। পরীক্ষায় বহিষ্কার হওয়াসহ পারিবারিক সমস্যার কথা ভেবে ভেবে মেয়েটি এখন মানসিক প্রতিবন্ধী।
সব সময় কথা বলতেই থাকে। নিজেই নিজের হাত-পা কামড়ায়, শরীর থেকে কাপড়-চোপড় খুলে ফেলে। সুযোগ পেলেই বাসা থেকে পালিয়ে যায়। কয়েকদিন আগেও সে বাসা থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। অনেক কষ্টে খোঁজাখুঁজির পর তাকে পাওয়া যায়। তাই কয়েক মাস ধরে তাকে শিকলে বন্ধি করে রেখেছি।
অর্থের অভাব থাকলেও অনেক চেষ্টা করছেন চিকিৎসার। স্থানীয় মানসিক চিকিৎসক আমজাদ হোসেনের নিকট প্রায় ১ বছর চিকিৎসা করা হয়েছে। পরে টাকা না থাকায় পাবনা মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানেও টাকার অভাবে তাকে রাখতে পারেননি। আবার তাকে ফেরত নিয়ে আসা হয়। এখন অর্থের অভাবে তার চিকিৎসা সম্পূর্ণ বন্ধ।
ফাহিমার ছোট বোন ফেরদৌসী বেগম বলেন, ফাহিমা আপা খুব মেধাবী ছিলেন। সব বুঝতেন তিনি। সংসার ভালো না চলার কারণে এসএসসি পাস করে চট্টগ্রামে যান গার্মেন্টসে চাকরি করতে। আমাদের বোনদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক ছিল। কিন্তু ফাহিমা আপা একটু আবেগ প্রবণ ছিলেন বেশি। সংসারে অভাব, পরীক্ষায় এক্সফেল হওয়া এবং বাবার মৃত্যু সবকিছু মেনে নিতে না পেরে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। অভাবের কারণে সঠিক চিকিৎসা করতে না পেরে দিন দিন ফাহিমা আপা বেশি অসুস্থ হয়ে পড়েন।
বোনদেরও সংসারে নেই স্বচ্ছলতা। বাকি বোনদের সহযোগিতা আর মায়ের বয়স্ক ভাতা এবং ফাহিমার প্রতিবন্ধী ভাতা দিয়েই চলছে সংসার।
রানীগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান মঞ্জুরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। তবে আমি খোঁজ-খবর নিয়ে পরিষদের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেব।