সিলেটে গল্প আড্ডায় কালজয়ী লেখক সমরেশ মজুমদার
কালজয়ী লেখক সমরেশ মজুমদারের নতুন বই ‘অপরিচিত জীবনযাপন’-এর প্রকাশনা উপলক্ষে সিলেটে গল্প আড্ডার আয়োজন করা হয়।
শুক্রবার এ আড্ডার মধ্যমণি ছিলেন লেখক নিজেই।
প্রথমবারের মতো সিলেট আসা জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদার সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের প্রশংসা করে বলেন, সিলেটে এসে আমি রোমাঞ্চিত হয়েছি। কারণ ভারতের উত্তরবঙ্গের যে চা বাগানে আমার দীর্ঘ সময় কেটেছে ঠিক সে জায়গার মতই সিলেট। সেই চা বাগান, সেই মাটি। আমি যখন এয়ারপোর্ট থেকে আসছিলাম তখন মনে হচ্ছিল সিলেটের সঙ্গে ভারতের উত্তরবঙ্গের সেই চা বাগানের ও এর আশপাশের এলাকার অনেক মিল।
গর্ভধারিনী, উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ’-এর লেখক সমরেশ মজুমদার বাতিঘর থেকে প্রকাশিত তার ‘অপরিচিত জীবনযাপন’ এর প্রকাশনা অনুষ্ঠানে সিলেটের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ছাড়াও অসংখ্য পাঠক তাকে ঘিরে আড্ডায় মেতে উঠেন।
‘বই প্রকাশের গল্প’ শিরোনামে আয়োজিত খোশগল্প, আড্ডায় দুই বাংলার জনপ্রিয় লেখক সমরেশ মজুমদার বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে বিভিন্ন সময় আমন্ত্রণ করেছেন। কিন্তু এর আগে বর্তমান সরকার বিরোধীরা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আমাকে বিমানবন্দরে আটকে দেয়া হয়েছিল। হুমায়ুন আহমেদ ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। তার সাথে কাটানো সময়গুলোর স্মৃতিচারণ করেন তিনি।
লেখক ও বাউল গবেষক সুমন কুমার দাশের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের শুরুতেই শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন বাতিঘরের কর্ণধার দীপঙ্কর দাস। এরপর কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার শুরু করেন তার গল্প।
বাতিঘর নিয়ে তিনি বলেন, বাতিঘরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক চট্টগ্রাম থেকে। ওই সময় বাতিঘরে আসার আগে মনে হয়েছিল কী আর হবে একটা বইয়ের দোকানই তো। কিন্তু বাতিঘরে এসে আমার ধারণা পাল্টে গিয়েছিল।
জনপ্রিয় এ লেখক বলেন, বইয়ের গন্ধ আর শ’য়ে শ’য়ে মানুষ দেখে আমি বিমোহিত হয়েছিলাম। শুনেছি পাঠকরাই নাকি সিলেটের বাতিঘর উদ্বোধন করেছেন। তাই সিলেটের পাঠকদের জন্যই আমি এসেছি। আপনাদের সামনে এসে আমি পুলকিত আনন্দিত।
বাতিঘরের কর্ণধার দীপঙ্কর দাশ বলেন, বাতিঘর শুধু বই ব্যবসার প্রতিষ্ঠান নয়। আমরা পাঠকদের জন্য পাঠদের নিয়ে কিছু করতে চাই। তাই আমাদের এই আয়োজন। সিলেটে বাতিঘর শুরুর আগে কথা দিয়েছিলাম আমরা লেখকদের নিয়ে এ রকম আড্ডার আয়োজন করবো। সেই কথা রাখতেই বাতিঘরের এ আয়োজন।
জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক সমরেশ মজুমদার বলেন, মঞ্চনাটকের প্রতি তার খুব টান ছিল। প্রথম গল্পও লেখেন যে নাট্যদলটির সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন সেই দলের একটি চিত্রনাট্য রচনার জন্য। যার নাম ছিল ‘অন্তর আত্মা’। কিন্তু সেটি নিয়ে মঞ্চদলটি নাটক করায় সেটি ছাপানোর জন্য দেশপত্রিকায় পাঠান তিনি। ছাপেনি তারাও।
তিনি বলেন, পরে এক বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে দেশপত্রিকার তৎকালীন সম্পাদক বিমল করের সঙ্গে যোগাযোগ হলে তিনি গল্পটি ছাপান। গল্প ছাপানোর ফলে পত্রিকা থেকে তাকে ১৫ টাকা দেয়া হয়। সেই টাকা তিনি বন্ধুদের নিয়ে কফি খেয়ে উড়িয়ে দেন।
এরপর এই খাওয়ার লোভে বন্ধুরা তাকে আরও লেখার জন্য তাগিদ দেন। সেই কফি খাওয়া ও খাওয়ানোর লোভ থেকেই সাহিত্যিক হিসেবে পর্দাপণ করেন সমরেশ মজুমদার।
আড্ডায় উঠে আসে ‘সাতকাহনে’র দীপাবলির কথাও। বলেন, আমার বাড়ির পাশে ১২ বছরের একটি মেয়েকে জোর করে বিয়ে দেয়া হয়। বিয়ের দিন সকালে সে আমার হাত ধরে বলেছিল, কাকু, আমাকে বাঁচাও। অনেক চেষ্টা করেও সেদিন মেয়েটির বিয়ে ঠেকাতে পারিনি। তবে বিয়ের আটদিন পর বিধবা হয়ে মেয়েটি ফিরে এসে আমাকে বলেছিল, কাকু, আমি বেঁচে গেলাম।
তিনি বলেন, এখান থেকে দীপাবলি চরিত্রটি তৈরি হয়। আমরা পুরুষরা মেয়েদের ওপর নির্ভরশীল জীবনযাপন করি। কিন্তু দীপাবলি এ ধরনের মেয়ে না। কোনো পুরুষই তাকে স্ত্রী হিসেবে চান না। আর মেয়েরা তাকে জীবনের আদর্শ মনে করে। এটাই এ চরিত্রের সার্থকতা।
দীর্ঘ এই আলাপচারিতায় বারবারই উঠে আসে তার উপন্যাস-ত্রয়ী ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’ ও ‘কালপুরুষ’ প্রসঙ্গ।
উপন্যাস-ত্রয়ী নিয়ে তিনি বললেন, এই তিনটির মধ্যে প্রথম দুটি অনেকটা জোর করে লেখা। মন থেকে লেখেননি। বলা যেতে পারে, বাধ্য হয়েই লিখেছেন। ‘উত্তরাধিকার’ প্রকাশ পরে পাঠকদের আগ্রহের পরে প্রকাশক সাগরময় ঘোষের নির্দেশে বাকি দুই পর্ব লেখা হয়।
গল্প বলা শেষে সমরেশ মজুমদারের হাত থেকে তার অটোগ্রাফসহ প্রি-অর্ডারকারীরা ১৫ জন পাঠক ‘অপরিচিত জীবনযাপন’ বইটি গ্রহণ করেন। অনুষ্ঠানে লেখক বাদল সৈয়দের ‘জন্মজয়’ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়।