৩৫ লাখ টাকার মেশিন ১ কোটি বেশি দিয়ে কিনল রংপুর মেডিকেল
রংপুর ব্যুরো
প্রকাশ: ২৩ জুন ২০১৯, ১১:৪৬ এএম
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল
রংপুর মেডিকেল কলেজে উপকরণ ক্রয়ে ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। পারস্পরিক যোগসাজসের মাধ্যমে দরপত্রে উপকরণের মূল্য কয়েকগুণ বাড়িয়ে বিপুল পরিমাণ সরকারি টাকা আত্মসাত করা হয়েছে।
এ অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে টেন্ডার কমিটির বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। তদন্তের প্রাথমিক পর্যায়ে যে পরিমাণ দুর্নীতির ঘটনার নথিপত্র হাতে পাওয়া গেছে তাতে বিস্মিত হয়ে পড়েছেন তদন্ত কমিটি।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, প্রতিটি যন্ত্রপাতি ও অন্যান্য মালামাল ক্রয়ের ক্ষেত্রে বাজার দর অনুযায়ী বিপুল পরিমাণ অসঙ্গতি দেখা গেছে, যেমন ইমমিনুসারি অ্যানালাইজার টেন্ডারে ক্রয়মূল্য দেখানো হয়েছে ১ কোটি টাকা, প্রকৃত বাজার মূল্য মাত্র ২০ লাখ টাকা একইভাবে ভিডিও অ্যান্ডোসকোপ টেন্ডারে ক্রয়মূল্য দেখানো হয়েছে ১ কোটি ৩৭ লাখ টাকা অথচ প্রকৃত বাজার মূল্য মাত্র ৩৫ লাখ টাকা। এভাবে সব মালামাল ক্রয়ের ক্ষেত্রে এভাবে বিপুল পরিমাণ আর্থিক দুর্নীতি করা হয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য দিনাজপুরের এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. কান্তা রায় রিমিকে কন্ডাক্টিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি তাকে দ্রুত স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন) বরাবর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য বলা হয়েছে।
সচেতন নাগরিক সমাজের সভাপতি অধ্যাপক একেএম হাবিবুল্লাহর অভিযোগের ভিত্তিতে এ তদন্ত শুরু হয়েছে বলে রমেক সূত্রে জানা গেছে।
অভিযোগে জানা গেছে, রংপুর মেডিকেল কলেজের ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের ইকুইপমেন্ট অ্যান্ড আদারস ইন্সট্রুমেন্টসহ প্রায় ৫ কোটি টাকার উপকরণ দরপত্রের মাধ্যমে ক্রয় করা হয়। যোগসাজসের মাধ্যমে দরপত্রে প্রতিটি পণ্যের মূল্য ৪-৫ গুণ বাড়িয়ে প্রায় ৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা অতিরিক্ত বিল দেয়া হয়।
টেন্ডারে অংশগ্রহণকারী ৩টি কোম্পানির মধ্যে সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে বেঙ্গল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড সার্জিকেল কোম্পানিকে কার্যাদেশ দেয়া হয়।
অভিযোগে বলা হয়, দরপত্রে কাটাকাটি করে বেঙ্গল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড সার্জিকেল কোম্পানিকে সর্বনিম্ন দরদাতা বানানো হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই টেন্ডারে জেনারেল কোম্পানির ২ টন ক্ষমতা সম্পন্ন ৩২টি এসি কেনা হয়েছে। প্রতিটির মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে ২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা। অথচ প্রকৃত বাজার মূল্য ৯০ হাজার টাকা।
এছাড়া ইমমিনুসারি অ্যানালাইজার টেন্ডারে ক্রয়মূল্য এক কোটি টাকা, প্রকৃত বাজার মূল্য ২০ লাখ টাকা, বায়োকেমিস্ট্রি অ্যানালাইজার টেন্ডারে ক্রয়মূল্য ৩ লাখ ৬৭ হাজার টাকা। প্রকৃত বাজার মূল্য ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। ডায়েটারমাই মেশিন টেন্ডারে ক্রয়মূল্য ২৫ লাখ টাকা। কিন্ত প্রকৃত বাজার মূল্য ১০ লাখ টাকা। ভিডিও অ্যান্ডোসকোপ টেন্ডারে ক্রয়মূল্য এক কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এর প্রকৃত বাজার মূল্য ৩৫ লাখ টাকা। আলট্রাসাউন্ড মেশিন ফর সাইথেরাপি টেন্ডারে ক্রয়মূল্য ১৪ লাখ ৬৬ হাজার ৫০০ টাকা। কিন্ত প্রকৃত বাজার মূল্য ৪ লাখ টাকা।
শর্ট ওয়েভ ফর সাইথেরাপি টেন্ডারে ক্রয় ৬১ লাখ ২৫ হাজার টাকা। কিন্ত প্রকৃত বাজার মূল্য ১২ লাখ টাকা। বায়োলজিকেল মাইক্রোস্কোপ টেন্ডারে ক্রয়মূল্য এক লাখ ৫৫ হাজার টাকা প্রকৃত বাজার মূল্য ৫৫ হাজার টাকা। ইলেকট্রলেট অ্যানালাইজার টেন্ডারে ক্রয়মূল্য ৫ লাখ ৯৫ হাজার টাকা, প্রকৃত বাজার মূল্য ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। এতে মোট ২ কোটি ৬৬ লাখ ৭ হাজার টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
আল আরাফাহ ইন্টারন্যাশনালসহ মেডিকেলের যন্ত্রপাতি বিক্রয়কারী বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ও বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে রংপুর মেডিকেল কলেজে সরবরাহকৃত যন্ত্রপাতিগুলোর কোম্পানি ও মডেল নম্বর অনুযায়ী প্রকৃত মূল্য জানা গেছে।
রংপুর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মুহাম্মদ নূর ইসলাম তদন্তের বিষয়টি স্বীকার করে যুগান্তরকে বলেন, তদন্ত কাজ সম্পন্ন করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্য অধিদফতরের নিয়োগকৃত কন্ডাক্টিং অফিসার অধ্যাপক ডা. কান্তা রায় রিমি প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত সরবরাহ করতে তাকে লিখিতভাবে অনুরোধ জানিয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, রংপুর মেডিকেল কলেজের ২০১৭-১৮ ও ২০১৮-১৯ অর্থ বছরের ইকুইপমেন্ট অ্যান্ড আদারস ইন্সট্রুমেন্ট, কেমিকেল অ্যান্ড রিএজেন্ট (এমএসআর) ও ইন্সট্রুমেন্ট ক্রয়ের লক্ষ্যে একটি দরপত্র কমিটি গঠন করা হয়।
উক্ত দরপত্রের মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে সচেতন নাগরিক সমাজের সভাপতি অধ্যাপক মো. এ.কে.এম হাবিবুল্লাহ অভিযোগ আকারে একটি আবেদনপত্র স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন) বরাবর দাখিল করেন। এরই প্রেক্ষিতে গত ২৬ মে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে দিনাজপুরের এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. কান্তা রায় রিমিকে কন্ডাক্টিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।
দিনাজপুরের এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. কান্তা রায় রিমি বলেন, রংপুর মেডিকেল কলেজের তৎকালীন দরপত্র কমিটির বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ তদন্ত করার জন্য তাকে কন্ডাক্টিং অফিসার হিসেবে স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। দরপত্র কমিটির কাছে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে। তারা অল্প সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রদান করবেন।
রংপুর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. নূর ইসলাম বলেন, নিয়ম মেনে টেন্ডারের মাধ্যমে উপকরণ কেনা হয়েছে। টেন্ডার কমিটির পক্ষ থেকে কোনো দুর্নীতি করা হয়নি।
একটি ২ টন এসির মূল্য কীভাবে ২ লাখ ৬৪ হাজার টাকা হয় এমন প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গিয়ে অধ্যক্ষ বলেন, টেন্ডারের আগে মূল্য যাচাই কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে। তারা বাজার দেখে মূল্য নির্ধারণ করেছে। বিগত দিনের চেয়ে তার সময়ে মেডিকেল কলেজে সবচেয়ে বেশি উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। একটি স্বার্থান্বেষী মহল তাকে সামাজিকভাবে হেয় করার জন্য নানা তৎপরতা চালাচ্ছে।
মূল্য যাচাই কমিটির আহবায়ক ডা. হৃদয় রঞ্জন রায় বলেন, রংপুর এবং ঢাকার বাজার যাচাই করে তারা যন্ত্রপাতিগুলোর প্রকৃত সম্ভাব্য মূল্য নির্ধারণ করে টেন্ডার কমিটির কাছে জমা দিয়েছেন। কিন্তু তাদের প্রদত্ত ক্রয়মূল্য আর টেন্ডারের ক্রয় মূল্য এক কি না সে বিষয়ে তিনি নিশ্চিত নন। তবে তিনি স্বীকার করেন, ২ টন ক্ষমতা সম্পন্ন এসির মূল্য ২লাখ ৬৪ হাজার হওয়ার কথা নয়।
টেন্ডার কমিটির সদস্য রংপুরের সিভিল সার্জন জাকিরুল ইসলাম লেলিন যুগান্তরকে জানান, টেন্ডার প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতার অভাবের কারণে তিনি সেখানে যাননি। টেন্ডার কমিটির অপর একজন সদস্য জেলা প্রশাসকের প্রতিনিধি সহকারী কমিশনার অতীশ দশী চাকমাকে টেন্ডার সম্পর্কে কোনো কিছু না জানানোর কারণে তিনি কোনো কাগজপত্রে স্বাক্ষর করেননি।
তিনি বলেন, বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানানো হলে জেলা প্রশাসক এনামুল হাবীব বিস্তারিত তথ্য জানতে চেয়ে গত বছরের ৮ জুলাই রমেক অধ্যক্ষকে চিঠি দেন। অধ্যক্ষ তার চিঠির কোনো জবাব দেননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রংপুর মেডিকেল কলেজের একজন শিক্ষক জানান, এ টেন্ডারে এমন কিছু যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে যা মেডিকেল কলেজে প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র অর্থ আত্মসাতের উদ্দেশ্যে ওসব যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে। তাছাড়া, যে ডিপার্টমেন্টের যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছে সেই ডিপার্টমেন্টের কোনো শিক্ষককে কমিটিতে রাখা হয়নি।
তিনি বলেন, কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের সহকারী শিক্ষক ডা. মো. সারোয়াত হোসেন চন্দনকে দরপত্র ও দরপত্র ওপেনিং কমিটিতে সদস্য সচিব হিসেবে রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয় তাকে বাজার যাচাই-বাছাই কমিটির সদস্য সচিব হিসেবে রাখা হয়। তিনি একাই তিনটি কমিটিতে আছেন। একইভাবে সার্জারী বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. শাহজাদা মিয়াকে ওই তিনটি কমিটির সদস্য রাখা হয়েছে। যা দরপত্র কমিটির বিধি-বিধান বহির্ভূত।
দরপত্র কমিটির অপর সদস্য হলেন কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. নওশাদুজ্জামান খান।