গরমে বেড়েছে তালপাখার কদর

মো. মঞ্জুরুল আলম মাসুম, বাগাতিপাড়া (নাটোর) থেকে
প্রকাশ: ০৯ মে ২০১৯, ১২:১৭ পিএম

নাটোরের বাগাতিপাড়ায় তালপাখা তৈরিতে ব্যস্ত নারী কারিগর। ছবি: যুগান্তর
হাতে তৈরি তালপাখা জীবন-জীবিকার অন্যতম মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার জামনগর ইউনিয়নের হাঁপানিয়া ফকিরপাড়া গ্রামের নারীদের। বছরের ছয় মাস হাতপাখা তৈরি তাদের দিয়েছে বাড়তি উপার্জনের সুযোগ।
নাটোর শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত হাঁপানিয়া গ্রামটিতে তালগাছ না থাকলেও এখন তালপাখার গ্রাম নামেই এর পরিচয়।
এখানে তালপাখা নারীদের করেছে স্বাবলম্বী। তবে প্রয়োজনীয় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও ঋণ সুবিধা না থাকায় সম্ভাবনাময় এ শিল্পটি বিকশিত হচ্ছে না।
সরেজমিন গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, গ্রামের প্রায় শতাধিক পরিবার পাখাশিল্পের সঙ্গে জড়িত। ভ্যাপসা গরমে তালপাখার চাহিদা বেশি থাকে বলেই নারীদের পুরুষরাও তালপাখা তৈরিতে সহায়তা করছেন।
তালপাখা তৈরির কারিগররা জানান, এর প্রধান কাঁচামাল ডাগুরসহ তালপাতা। উত্তরের জেলা নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে তালপাতা কিনে আনতে হয় পৌষ মাসের শুরুতে। প্রতিটি পাতা কিনতে খরচ পড়ে ৫ থেকে ৭ টাকা। এই পাতা গোল করে কাটা হয় সতর্কতার সঙ্গে। কাটার পর রোদে শুকানো হয় কয়েক দিন। শুকানো শেষে গুচ্ছ হয়ে থাকা ডাগুরের সংকুচিত পাতা প্রসারিত করা হয় বাঁশের তৈরি কাঠির মাধ্যমে।
তারা আরও বলেন, পাতার এক একটি শিরা প্রসারিত করে কয়েক শিরা মিলে দুই প্রান্তে আটকানো থাকে কাঠি। এভাবে রাখার পর তালপাতা স্বাভাবিক প্রসারিত আকার ধারণ করলে গোলাকার পাখাটি রঙ করা বাঁশের খিল দিয়ে দুপাশ আটকে সেলাই করে দেয়া হয়।
কারিগররা জানান, একটি তালপাখা কাঁচামাল থেকে তৈরি করতে খরচ হয় আরও ২ থেকে ৩ টাকা। গড়ে পিত পিস ১০-১১ টাকা খরচ পড়ে তালপাখার। কারিগররা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা পাইকারদের কাছে বিক্রি করেন ১২-১৫ টাকা পিস।
প্রধানত রাজধানী ঢাকা, টাঙ্গাইল, খুলনা, পাবনা ও সিরাজগঞ্জে তালপাখার চাহিদা মেটায় হাঁপানিয়ার পাখা। সংসারের নিত্য কাজকর্মের পাশাপাশি পৌষের শুরু থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত পাখা তৈরি করে বাড়তি আয় করছেন নারীরা।
তবে এর মজুরি একেবারেই কম। ১০০ পিস পাখা তৈরি করলে মজুরি পাওয়া যায় ৩৫ টাকা। ৩ থেকে ৫ জন নারী একসঙ্গে বসলে ঘণ্টায় ৩০০ পিস পাখা অনায়াসে তৈরি করতে পারে।
হাঁপানিয়া গ্রামের ষাটোর্ধ্ব বয়সী বৃদ্ধা সাবেজান বেগম জানান, তিনি এ গ্রামে বউ হয়ে আসার পর থেকে অদ্যাবধি তালপাখা তৈরি করছেন। তালপাখা তৈরি করেই তিনি তার সন্তানদের মানুষ করেছেন ও বিয়ে দিয়েছেন। এখন তার পুত্রবধূ ও সংসারে বাড়তি উপার্জনের জন্য পাখা তৈরি করেন।
স্থানীয় মাহাতাব হোসেন বলেন, এখানকার মানুষের বাড়তি আয়ের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হওয়ার অনন্য দৃষ্টান্ত এখন এই তালপাখার গ্রাম হাঁপানিয়া।
তবে বিভিন্ন এনজিও থেকে চড়াসুদে ঋণ নিয়ে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। এ ছাড়া ঋণের টাকার সুদ বেশি হওয়া লাভের পরিমাণ কম হয় তাদের।
পাখাশিল্পী মকলেসুর রহমান জানান, গত অর্থবছরে এ পল্লীর ‘পাখা শিল্প উন্নয়ন সমিতি’ তালগাছ রোপণের জন্য ৯০ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছিল। অনুদানের টাকায় আড়ানী-পুঠিয়া সড়কের উমরগাড়ি থেকে ফুলতলা পর্যন্ত রাস্তার দুধার এবং মুসা খাঁ নদীর দুপাড়ে এক হাজার ৪০০ তালগাছের চারা লাগানো হয়েছে।
এ ব্যাপারে স্থানীয় জামনগর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল কুদ্দুস বলেন, তালপাখার এই শিল্পকে ধরে রাখতে হবে। তাদের জীবন মানের উন্নয়ন দরকার। তাদের জন্য কম সুদে সরকারিভাবে ঋণ সুবিধা দিলে এ শিল্পটি বিকশিত হতে পারে। এতে কর্মসংস্থানেরও সৃষ্টি হবে।