লোহাগড়ার অপ্রতিরোধ্য নমিতার দেশসেরা হওয়ার গল্প

বিপ্লব রহমান, লোহাগড়া (নড়াইল) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২২ এপ্রিল ২০১৯, ০৪:৪৪ এএম

লোহাগড়ার অপ্রতিরোধ্য নমিতা কর্মকার
বাবা মাখন কর্মকার দিনমজুর। মা চায়না কর্মকার অন্যের বাড়িতে কাজ করেন। এই পরিবারের কিশোরী কন্যা নমিতা কর্মকার এখন দেশসেরা খেলোয়াড়।
জাতীয় জুনিয়র অ্যাথলেটিকসে জ্যাভলিন থ্রোতে (বর্ষা নিক্ষেপ) পূর্বের সব রেকর্ড ভেঙ্গে ছিনিয়ে নিয়েছেন স্বর্ণপদক। নারী হকিস্টিকে হয়েছেন ইতিহাসের অংশ।
কিশোরী নমিতার নাম এখন মানুষের মুখে মুখে। মাশরাফি, হরশিতের পরেই এখন নমিতার প্রশংসা।
নমিতা নড়াইলের লোহাগড়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এ বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করবে।
লোহাগড়া পৌর শহরের কচুবাড়িয়ায় তাদের বসবাস। সাড়ে ৭ শতাংশ জমির ওপর বসতভিটাই তাদের সম্বল। এখানে ছোট্ট দুটি টিনের ঘরে তাদের বসবাস। অন্য কোনো জমিজমা নেই। নেই আর কোনো আয়।
বাবা মাখন কর্মকারের বয়স প্রায় ৬০। কানে শোনেন না। এক চোখে দেখেন না। মাজায় ব্যাথা। বুকে ব্যাথা। শরীরের নানা অসুস্থতায় কর্ম অক্ষম প্রায়। আগে ছিলেন কাঠুরে। এখন শক্ত পরিশ্রমের কাজ করতে পারেন না। তাই পানের বরজে কাজ করেন। কিন্তু এটি মৌসুমি কাজ। প্রায় ছয় মাস বর্ষার কারণে কাজ থাকে না। তখন পরিবারের সদস্যদের নির্ভর করতে হয় নমিতার মায়ের ঝিয়ের কাজের ওপর।
অবশ্য বছর দুই হলো জ্যাভলিন খেলোয়াড় হিসেবে বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনে (বিজেএমসি) যোগ দিয়েছেন নমিতা। বেতন পান সপ্তাহে ১৯০০ টাকা। এই টাকা সংসারে যোগ হয়, চলে তাদের সংসার।
মাখন কর্মকারের তৃতীয় সন্তান নমিতা। বড় দুই মেয়ে বিয়ে দিয়েছেন। এখন পাঁচজনের সংসার। ছোট মেয়ে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা দিয়েছে। ছেলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে।
নমিতা ৩৪তম জাতীয় জুনিয়র অ্যাথলেটিকসে জ্যাভলিন থ্রোতে ৩৬ দশমিক ৩৬ মিটার দূরত্ব অতিক্রম করে স্বর্ণ জিতেছেন। এটিই এ যাবৎকালের দূরত্বের সর্বোচ্চ রেকর্ড।
ঢাকার বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে গত ২৮ ও ২৯ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত এই অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় চাকতি নিক্ষেপে ও শটপুটে হয়েছেন দ্বিতীয়।
২০১৪ সাল থেকে জুনিয়র অ্যাথলেটিকসে খেলে আসছেন নমিতা। নতুন রেকর্ড গড়ে অ্যাথলেটিকসে এখন জাতীয় পর্যায়ে পরিচিত মুখ জ্যাভলিনের স্বর্ণকন্যা নমিতা।
এদিকে নারী হকিতে এই প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচে ভারতের বিরুদ্ধে সিরিজ জয় করে নমিতারা হয়েছেন ইতিহাসের অংশ। দুই ম্যাচে ঢাকা একাদশের করা ৫ গোলের মধ্যে দুটিই এসেছে নমিতার স্টিক থেকে।
গত ৭ ও ৮ নভেম্বর ঢাকার মাওলানা ভাসানী স্টেডিয়ামে ভারতের কলকাতা ওয়ারিয়র্সের সঙ্গে এই খেলা হয়। কলকাতা ওয়ারিয়র্স হলেও খেলোয়াড়েরা ভারতের উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, মধ্যপ্রদেশ ও ঝাড়খণ্ড থেকে এসেছিলেন।
কেবল অ্যাথলেটিকসেই নয়, হকিস্টিক হাতেও দুর্বার নড়াইলের কিশোরী নমিতা। গোল করেছেন, করিয়েছেনও। ঢাকা একাদশের সেরা পারফরমার হয়েছিলেন তিনি। দেশের নারী ক্রীড়াঙ্গন এবার নতুন করে চিনলো নমিতাকে।
‘ছোটবেলা থেকেই ঝোঁক ছিল খেলাধুলায়। শুরু ফুটবল দিয়ে। অ্যাথলেটিকস হয়ে এখন হকিতে। আমি হকি নিয়েই এখন বেশি স্বপ্ন দেখি’, বলছিলেন নমিতা।
রোববার দুপুরে যুগান্তরকে নমিতা এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘দেশে একদিন হকিতে নারীদের জাতীয় দল হবে। সে দলে খেলবেন নমিতা। ক্রিকেটের মতো বাংলাদেশকে নিয়ে যাবেন অনন্য উচ্চতায়।’
নমিতার খেলার হাতেখড়ি তার বিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষক দিলীপ চক্রবর্তীর কাছে। দিলীপ চক্রবর্তী বললেন, ‘হকিতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা নেই। নিজের চেষ্টায় উঠছে নমিতা। নমিতাদের লালন করা গেলে হবে এ দেশের বড় সম্পদ।’