দুই আসামির স্বীকারোক্তি
নুসরাতের গায়ে আগুন দেয়ার সিদ্ধান্ত আসে জেল থেকে
যুগান্তর ডেস্ক
প্রকাশ: ১৫ এপ্রিল ২০১৯, ১১:১৮ এএম
নুসরাত হত্যায় দুই আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি। ছবি: সংগৃহীত
জেলখানা থেকে হুকুম পেয়েই নুসরাতকে হত্যার উদ্দেশে গায়ে আগুন দেয় আসামিরা।হুকুম দেন মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলা। এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ১৩জন। এদের মধ্যে ৪ জন সরাসরি জড়িত। বাকিরা পরোক্ষভাবে জড়িত। সরাসরি জড়িত ৪জনের মধ্যে দুজন গ্রেফতার হয়েছে।সেই দুজন আদালতে দেয়া জবানবন্দিতে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য দিয়েছে।
ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার দায় স্বীকার করে রোববার ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেয় মামলার অন্যতম আসামি নুর উদ্দিন ও শাহদাত হোসেন শামীম।
রোববার বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম জাকির হোসাইনের আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়া শুরু করেন আসামি নুর উদ্দিন। রাত সাড়ে ৯টায় তার জবানবন্দি নেয়া শেষ হয়। এরপর রাত দেড়টা পর্যন্ত জবানবন্দি দেন শাহদাত হোসেন শামীম।
পরে রাত ১টার দিকে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড অপারেশন) তাহেরুল হক চৌহান তাদের বিষয়ে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
তিনি বলেন, আসামিরা অপরাধ স্বীকার করেছেন। তারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন বলে দায় স্বীকার করেছেন। তারা জেলখানা থেকে মাদ্রাসা অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলার কাছ থেকে হুকুম পেয়ে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন।
তাহেরুল হক চৌহান জানান, এ পর্যন্ত এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ১৩ জনের নাম এসেছে। এছাড়া বিক্ষিপ্তভাবে কিছু নাম এসেছে। পুলিশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও অন্যান্য তথ্য-উপাত্ত খতিয়ে দেখে সে বিষয়ে নিশ্চিত হবে।
হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িত যে চারজন তাদের সবাইকে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি। দুজন গ্রেফতার আছে, বাকি দুইজনকে গ্রেফতারে অভিযান চলছে। যেকোনো সময় তাদের গ্রেফতার করা সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন চৌহান।
তাহেরুল হক চৌহান বলেন, আদালত দীর্ঘ সময় ধরে তাদের সিআরপিসির ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিতে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। আসামিরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিজ্ঞ আদালতের কাছে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। আসামিরা পুরো বিষয় খোলাসা করেছেন।
হত্যাকাণ্ডটি কারা ঘটিয়েছে, কীভাবে ঘটিয়েছে, কী প্রক্রিয়ায় ঘটিয়েছে বিস্তারিত বলেছেন। কিন্তু তা আপনাদের সামনে মামলার তদন্তের স্বার্থে পেশ করবো না।
জবানবন্দিতে নুর বলেছেন, এপ্রিলের ১ ও ৩ তারিখ কারাগারে আটক মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলার সঙ্গে দেখা করেন তিনি। সেখানেই নুসরাতের গায়ে আগুন দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। অধ্যক্ষের পরামর্শেই নুসরাতের গায়ে আগুন ধরানো হয়।
অন্যদিকে মামলার তদন্তকারী সংস্থা পিবিআইয়ের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ঘটনার দিন আনুমানিক সকাল ৯টা থেকে সাড়ে ৯টায় ঘটনাস্থলে ছিলেন নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, জাবেদ হোসেন, হাফেজ আবদুল কাদের এবং আরও কয়েকজন। তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম বলা যাবে না।
তিনি বলেন, ‘যৌন নির্যাতনের মামলা হওয়ায় আলেম সমাজকে হেয় করা হয়েছে- এই ধরনের যুক্তি দিয়ে অধ্যক্ষ সিরাজ জেলে থেকেই তার সাঙ্গপাঙ্গোদের নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে মারার নির্দেশ দেন।’
বনজ কুমার আরও বলেন, ‘নুসরাতকে পুড়িয়ে মারার আরও একটি কারণ আমরা জেনেছি। তা হলো- নুসরাতকে মামলার এজহারভুক্ত তৃতীয় আসামি শাহাদাত প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে সে প্রস্তাব নুসরাত ফিরিয়ে দেয়। বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি শাহাদাত। মনে মনে প্রচণ্ড ক্ষোভ জন্মে তার। নুরসাতকে পুড়িয়ে মারার পেছনে সেই আক্রোশটাও কাজ করেছে। ’
বৃহস্পতিবার রাতে ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে নূর উদ্দিন ও পরদিন শুক্রবার সকালে মুক্তাগাছা থেকে শাহাদাত হোসেন শামীমকে গ্রেফতার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। নূর উদ্দিন নুসরাত হত্যা মামলার ২নং ও শাহাদাত হোসেন শামীম ৩নং আসামি।
নুসরাত হত্যা মামলায় এখন পর্যন্ত ১৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের মধ্যে এজাহারভুক্ত ছয় আসামি এবং এজাহারবহির্ভূত সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ওই মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাসহ ১১ জন আসামি রিমান্ডে রয়েছেন।
এর আগে গত ৯ এপ্রিল সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সরাফ উদ্দিন আহম্মেদের আদালত নূর হোসেন, কেফায়াত উল্লাহ, মোহাম্মদ আলা উদ্দিন ও শাহিদুল ইসলামের পাঁচদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
পরদিন ১০ এপ্রিল অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদ দৌলাকে সাতদিন, আবছার উদ্দিন ও আরিফুল ইসলামকে পাঁচদিন করে রিমান্ড দেন একই আদালতের বিচারক। ১১ এপ্রিল উম্মে সুলতানা পপি ও যোবায়ের হোসেনকে পাঁচদিন করে রিমান্ড দেন একই আদালতের বিচারক সরাফ উদ্দিন আহম্মেদ।
১৩ এপ্রিল শনিবার মামলার আরেক আসামি জাবেদ হোসেনকে সাত দিনের রিমান্ড দিয়েছেন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. জাকির হোসাইন।
গত বুধবার রাত সাড়ে ৯টায় আইসিইউতেই মারা যান ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি। পরদিন জানাজা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
৬ এপ্রিল সকালে আলিম পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় যান নুসরাত জাহান রাফি। মাদ্রাসাছাত্রী তার বান্ধবী নিশাতকে ছাদের ওপর কেউ মারধর করছে এমন সংবাদে তিনি ছাদে যান। সেখানে বোরকাপরা ৪-৫ জন তাকে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ-দৌলার বিরুদ্ধে করা শ্লীলতাহানির মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়।
অস্বীকৃতি জানালে তারা রাফির গায়ে আগুন দিয়ে পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় সোমবার রাতে অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা ও পৌর কাউন্সিলর মুকছুদ আলমসহ আটজনের নাম উল্লেখ করে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন অগ্নিদগ্ধ রাফির বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান।
এর আগে ২৭ মার্চ ওই ছাত্রীকে নিজ কক্ষে নিয়ে শ্লীলতাহানি করেন অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা। এ ঘটনায় ছাত্রীর মা শিরিন আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন। ওই দিনই অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলাকে আটক করে পুলিশ। সে ঘটনার পর থেকে তিনি কারাগারে আছেন।