হাওরে বোরো ধানে চিটা, দিশাহারা কৃষক

খালিয়াজুড়ী (নেত্রকোনা) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৯ এপ্রিল ২০১৯, ০৯:৪৮ এএম

হাওরে বোরো ধানে চিটা। ছবি: সংগৃহীত
নেত্রকোনার খালিয়াজুড়ীর হাওরে বোরো ধানে চিটা দেখা দিয়েছে। এছাড়া অব্যাহত ঝড়-শিলাবৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছেন হাওরপাড়ের কৃষক। উঠতি বোরো ধানে এ বিপর্যয়ে তারা এখন দিশাহারা। মাত্র কয়েক দিন আগে যে কৃষক সোনার ফসল ঘরে তোলার স্বপ্ন দেখতেন, তারা আজ ধান ক্ষেতের আইলে বসে ডুকরিয়ে কাঁদছেন।
আট একর জমির ব্রি-ধান-২৮ মাড়াই করে মাত্র ৮০ মন ধান পেয়েছেন খালিয়াজুড়ীর সরকারহাটির কৃষক কাচু মিয়া। অর্থাৎ একরপ্রতি তিনি ফলন পেয়েছেন মাত্র ১০ মণ ধান। অথচ বরাবর তার এ জমিতে কমপক্ষে ৩৬০ মণ থেকে ৪০০ মণ ধান উৎপাদন হয়।
শুধু কাচু মিয়াই নয়, এই হাওরের হাজার হাজার কৃষকের হয়েছে এমন অবস্থা। এই কৃষককূল সবসময় বৈরী প্রকৃতি ও আগাম বন্যার ঝুঁকিতে থাকেন।
পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টিতে প্রায় প্রতি বছর আগাম বন্যায় তলিয়ে যায় কৃষকের সোনালি ফসল। এখন হাওরপাড়ের কৃষক পরিবারগুলোতে বোরো ধান কাটা-মাড়াইয়ের ধুম লাগার কথা ছিল। কিন্তু এবার সেই আমেজ নেই।
অনেকের ঘরে শোকের আবহ। ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তার আহাজারি। কোনো কোনো কৃষক ধান কাটছেন ঠিকই, কিন্তু ধানের ছড়ায় ধান নেই বেশিরভাগই চিটা (ফাঁকা ধান)। এসব দেখে কৃষি বিভাগও রীতিমতো কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
কৃষি বিভাগের বিশেষজ্ঞরা এ সমস্যাটির নাম দিয়েছেন কোল্ড ইনজুরি। খালিয়াজুড়ী কৃষি অফিসের সূত্রমতে ছয় ইউনিয়নে এবার ১৯ হাজার ৮৭০ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ হয়। এর মধ্যে কৃষি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী চিটায় আক্রান্ত হয়েছে পাঁচ হাজার হেক্টর জমি।
তবে স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায় প্রকৃত আক্রান্ত জমির সংখ্যা আরও অনেক বেশি।
বিশেষ করে, খালিয়াজুড়ীর পাঙ্গাশিয়া, কির্তনখোলা, কটিচাপরা, সেনের বিল, জালর বন, সোনাতোলা, বল্লীর চৌতরা, জগন্নাথপুরের বড় হাওর, বাজজোয়াইল, পাঁচহাট, নগর, বোয়ালী, চাকুয়ার হাওরের হাজার হাজার হেক্টর জমির ফসল চিটায় পরিণত হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, খালিয়াজুড়ীর সদরের মো. রাজু মিয়া ২০ একর জমিতে বোরো ধানের চাষ করেন, এর মধ্যে চিটা হয়েছে ১১ একর জমিতে।
বহিরাগত কৃষক (জিরাতি) মো. হারুন-অর-রশিদ আবাদ করেছেন ৭০ একর তার আক্রান্ত হয়েছে ৩০ একর। অনল মিয়ার পাঁচ একরের মধ্যে সম্পূর্ণ জমিতে চিটা হয়েছে। এইভাবে বল্লী গ্রামের বাবুল মিয়া ১৫ একর জমি চাষ করেন, এর মধ্যে চিটা হয়েছে ১৩ একর। ওই গ্রামের নেহের মিয়া সাত একর জমি চাষ করে একমুট ধানও পায়নি।
একইভাবে খালিয়াজুড়ীর রফিকুল ইসলাম ছোটনের ছয় একরের মধ্যে তিন একর জাহের মিয়ার। এই তিন একরের মধ্যে দুই একর এবং গছিখাই গ্রামের শফিকুলের ১৫ একরের মধ্যে ১০ একর চিটায় আক্রান্ত হয়েছে।
হাওরের গ্রামগুলোতে এ রকম কৃষকের সংখ্যা আরও বহু। আক্রান্ত কয়েকটি হাওর ঘুরে দেখা যায়, এসব জমির ধানের ছড়া সোজা হয়ে ওপরের দিকে দাঁড়িয়ে আছে।
স্বাভাবিক অবস্থায় ধানের ভারে ছড়া নিচের দিকে নুয়ে থাকে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা জানান, বিগত বছরগুলোতে ১ একর (১০ কাঠা) জমিতে কম করে হলেও ৬০ মণ ধান উৎপন্ন হয়েছে। এবার একরে ১০ মণ ধানও হয়নি।
এতে করে অনেকের উৎপাদন খরচও উঠবে না। কেন হলো এমন অবস্থা? এ ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলাম উপজেলা কৃষি অফিসার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলামের কাছে। তিনি জানান, জমির ফ্লাউয়ারিং স্টেজের পর ধানের ছড়ায় দানা গঠন (চাল) হয়। এ জন্য নির্দিষ্ট তাপমাত্রার প্রয়োজন পড়ে।
কিন্তু এবার তাপমাত্রা অপেক্ষাকৃত কম থাকায় ধানের মধ্যে ঠিকমতো দানা গঠন হয়নি। ফলে অনেক জমিতে চিটা (ফাঁকা ধান) হয়।
এ সমস্যাটিকে বলা হয় কোল্ড ইনজুরি বা ঠাণ্ডাজনিত কারণ। কয়েকজন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা জানান, যেসব কৃষক জমিতে আগাম (ডিসেম্বরের শুরুতে) চারা রোপণ করেছেন, তাদের জমি আক্রান্ত হয়েছে বেশি। এর মধ্যে বিশেষ করে ব্রিধান-২৮ ধানের জমিই বেশি আক্রান্ত হয়েছে।
তবে কৃষকরা জানান, অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকা হওয়ায় এবং আগাম পানি চলে যাওয়ায় তাড়াতাড়ি চারা রোপণ করা হয়। অতিথি এমন সমস্যায় পড়েনি। এ ব্যাপারে খালিয়াজুড়ী উপজেলার মেন্দিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান লোকমান হেকিম যুগান্তরকে বলেন সমস্যা যেন কৃষকের পিছু ছাড়ছে না।
সাধারণত এনজিও, ব্যাংক ও মহাজনি ঋণ নিয়ে হাওরের কৃষকরা জমি চাষাবাদ করেন। কিন্তু এবার ফসল বিপর্যয় হওয়ায় অনেক কৃষকের পক্ষে গরু, বাছুর, বাড়িঘর বিক্রি করে ঋণ পরিশোধ করা সম্ভব হবে না।