মানবসেবার নন্দিত আলোঘর হামদর্দের ১১৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী
সংবাদ বিজ্ঞপ্তি
প্রকাশ: ৩১ জুলাই ২০২৩, ০৬:৪২ পিএম
উপমহাদেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও মানবসেবার নন্দিত প্রতিষ্ঠান হামদর্দ ল্যাবরেটরীজের ১১৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।
গৌরবান্বিত ১১৭ বছর শেষ করে ১ আগস্ট হামদর্দ পা রাখবে আলোকিত ১১৮ বছরে।
হামদর্দ পরিবার প্রতিষ্ঠার্ষিকীর এই শুভক্ষণে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছে প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা পরম শ্রদ্ধেয় হাফেজ হাকীম আবদুল মজিদ, তার সম্মানিত স্ত্রী রাবেয়া মজিদ, দুই সন্তান প্রখ্যাত ইউনানী চিকিৎসা বিজ্ঞানী হাকীম আবদুল হামিদ এবং শহীদ হাকীম মোহাম্মদ সাঈদকে। পাশাপাশি তাদের বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনাও করছে হামদর্দ পরিবার।
১৯০৬ সালে উপমহাদেশে চলছিল ব্রিটিশ অপশাসন। ভারতের দিল্লিতে মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নির্বিঘ্নে করতে হাকীম হাফেজ আব্দুল মজিদ প্রতিষ্ঠা করেন হামদর্দ।
কিন্তু অত্যন্ত দু:খের বিষয় মাত্র ৪০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন ইউনানী চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রখ্যাত চিকিৎসক হাকীম হাফেজ আব্দুল মজিদ। তার দুই সন্তান হাকীম আব্দুল হামিদ ও হাকীম মোহাম্মদ সাঈদকে নিয়ে নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে হামদদের্দর হাল ধরেন স্ত্রী রাবেয়া মজিদ।
সময়ের পালাক্রমে দুই সন্তান হাকীম আবদুল হামিদ ও হাকীম মোহাম্মদ সাঈদ পরিণত হন উপমহাদেশের প্রথিতযশা ব্যক্তিত্বে।
বড় সন্তান হাকীম আবদুল হামিদ ভারতে হামদর্দ ল্যাবরেটরীজকে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত করেন। স্বাস্থ্যসেবার পাশাপাশি স্কুল কলেজ মাদ্রাসা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলে মানবসেবার অনন্য উদাহরণ তৈরি করেন।
হাকীম মোহাম্মদ সাঈদ ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হওয়ার সময় তিনি সপরিবারে পাকিস্তানের করাচি চলে যান। সেখানেই তিনি পরবর্তিতে হামদর্দ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫৩ সালে হাকীম মোহাম্মদ সাঈদ পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে ঢাকায় বর্তমানে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে হামদর্দের প্রথম শোরুম উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অবিসংবাদিত নেতা শেরেবাংলা একে ফজলুল হক।
১৯৫৯ সালে হাকীম মোহাম্মদ সাঈদ চট্টগ্রামের ১৯, আইচ ফ্যাক্টরি রোডে দ্বিতীয় শোরুম চালু করেন।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ মুক্তির লড়াইয়ে ঝাপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম, মা বোনের সম্ভ্রম আর শহীদের রক্তের বিনিময়ে আসে স্বাধীনতা।
মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে হামদর্দ একটি ধ্বংসপ্রাপ্ত ও রুগ্ন প্রতিষ্ঠান হিসিবে চিহ্নিত হয়। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত সময়কালে পর্যায়ক্রমে ৭ জন মোতাওয়াল্লী নিয়োগ দেওয়া হয়। তারা হামদর্দকে যথাযথভাবে পরিচালনা করতে না পারায় ব্যাপক বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়।
১৯৭৫ সালে ষড়যন্ত্র করে হামদর্দ বাংলাদেশকে লেঅফ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তাতে বাধা দিয়ে প্রতিষ্ঠানকে সচল রাখেন ড. হাকীম মো. ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া। ১৯৭৭ সালে মোতাওয়াল্লী হিসেবে নিয়োগ পান তৎকালীন সিনিয়র কর্মকর্তা নুরুল আফসার। কিন্তু তিনি না কারণে প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় ভূমিকা রাখতে পারেন নি। ড. হাকীম মো.ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া সবার মধ্যে সাহস সঞ্চার করে বলেন, আল্লাহর রহমত এবং আমাদের প্রচেষ্টায় হামদর্দ ঘুরে দাঁড়াবে ইনশাল্লাহ। এ সময় তিনি নেপথ্যে থেকে দৃঢ়ভাবে হাল ধরেন।
১৯৮২ সালে হামদর্দ বাংলাদেশের পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেন ড. হাকীম মো. ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় মাত্র ৫০ হাজার টাকার মূলধন এবং ছয়গুন ঋণ নিয়ে ঘুরে দাঁড়ায় প্রতিষ্ঠান। এত অল্প মূলধন নিয়ে হামদর্দের অগ্রযাত্রার এ তথ্যটি ওয়াক্ফ প্রশাসনে এখনো সংরক্ষিত রয়েছে।
১৯৮২ সালে বাংলাদেশ ড্রাগ পলিসিতে প্রাকৃতিক চিকিৎসা ব্যবস্থাকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অন্তর্ভূক্ত করতে উদ্যোগী হন হামদর্দ ট্রাস্টি বোর্ডের তৎকালীন ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা.নুরুল ইসলাম, ট্রাস্টি বোর্ডের অন্যতম সদস্য তৎকালীন ওষুধ প্রশাসনের পরিচালক ড. হুমায়ুন কে এম এ হাই ও গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ট্রাস্টি ডা.জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখেন ড. হাকীম মো. ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া। এ স্বীকৃতির কারণে সরকারি হাসপাতালে নিয়োগ পাচ্ছে ইউনানী আয়ুর্বেদিক চিকিৎসকরা। ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে আসায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়েছে। এর ফলে তৈরি হয়েছে ইউনানী-আয়ুর্বেদিক ফর্মুলারী।
১৯৮৩ সাল থেকে বিশ্বের মুসলমানের দ্বিতীয় বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব বিশ্ব ইজতেমায় হামদর্দ মেডিকেল ক্যাম্প করে ফ্রি চিকিৎসা সেবা দেওয়া শুরু করে। যা আজও অব্যাহত আছে। এর ফলে ইজতেমায় আগত বিপুল সংখ্যক ধর্মপ্রাণ মানুষ উপকৃত হচ্ছেন।
১৯৮৪ সালে হামদর্দ কারখানায় হামলা চালায় একদল দুর্বৃত্ত। আল্লাহর একান্ত ইচ্ছায় মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান ড. হাকীম মো. ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া। তিনি জীবনের বিনিময়ে হামদর্দকে এগিয়ে নেওয়ার শপথ নেন। ফলে কর্মীরা নতুন্য উদ্যমে কাজ করার সাহস ও অনুপ্রেরণা পায়।
১৯৮৬ সালে একজন মোতাওয়াল্লীই নিয়ন্ত্রণ করতেন সবকিছু। কিন্তু ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া ক্ষমতার বিভাজন করতে এবং সবার পরামর্শ নিয়ে স্বচ্ছতার সঙ্গে হামদর্দকে পরিচালনা করতে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ৯ সদস্যের সমন্বয়ে ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করেন। সেই ধারাবাহিকতায় অব্যাহত আছে ট্রাস্টি বোর্ডের মতামত নিয়ে প্রত্যেকটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার রীতি।
বিভিন্ন সময়ে প্রলয়ংকরী বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাস পরবর্তি ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে হামদর্দ।
১৯৯০ সালে উত্তরাঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র বগুড়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় হামদর্দ ইউনানী মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতাল।
১৯৯৪ সাল। ঢাকার অদূরে ছায়াসুনিবিড় সোনারগাঁওয়ে আধুনিক কারখানার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন হাকীম মোহাম্মদ সাঈদ। এরপর বিপুল কর্মদ্যোগে ওষুধ উৎপাদনে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করে হামদর্দ। অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে ১৯৯৮ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ফান্ডে অনুদান প্রদান করে হামদর্দ। ২০০৪ সালে ড. হাকীম মো. ইউছুফ হারুন ভূঁইয়ার একক প্রচেষ্টায় ইউনানী আয়ুর্বেদিক ও হার্বাল ওষুধ শিল্প থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার করে সরকার। এই খাতের জন্য এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ফলে প্রতিষ্ঠিত হয় নতুন অনেক শিল্প কারখানা। বাড়ে কর্মসংস্থান এবং ওষুধের বাজার।
হাকীম মো. সাঈদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ২০০৮ সালে শিক্ষা বিস্তারে অসাধারণ উদ্যোগ গ্রহণ করেন ড. হাকীম মো. ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া। হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের জন্য জমি ক্রয় করেন এবং মাটি ভরাটের কাজ শুরু হয়। স্বপ্নের এই প্রতিষ্ঠানের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন হাকীম মো. সাঈদের সুযোগ্য কন্যা সাদিয়া রশিদ। শহীদ হাকীম মোহাম্মদ সাঈদের অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ একই বছর নামে ঢাকায় প্রতিষ্ঠা করা হয় হাকীম সাঈদ ইস্টার্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল।
২০১০ সালে ড. হাকীম মো. ইউছুফ হারুন ভূঁইয়ার উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় হামদর্দ পাবলিক কলেজ। যা এখন স্বনামধন্য একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে সবার কাছে পরিচিত। প্রতিবছর সফলতার সঙ্গে শতভাগ উত্তীর্ণ হয় এই কলেজের শিক্ষার্থীরা। ইতোমধ্যে অসংখ্য শিক্ষার্থী কলেজ থেকে উত্তীর্ণ হয়ে বুয়েট, মেডিকেল এবং বিশ^বিদ্যালয়ের পাঠ শেষে কর্মজীবনে দেশ ও জাতি গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন।
২০১২ সালে ড. হাকীম মো. ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া প্রতিষ্ঠা করেন হামদর্দ বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ। একই সালে হামদর্দ প্রধান কার্যালয়ে উদ্বোধন করা হয় বঙ্গবন্ধু কর্নার উদ্বোধন। যে কর্নারে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দুর্লভ গ্রন্থের সমাহার।
২০২১ সালে এ্যালোপ্যাথিক, ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক এই তিন পদ্ধতির সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠা করা হয় হামদর্দ জেনারেল হাসপাতাল। ভারতের স্বাস্থ্য বিষয়ক আয়ুশ মন্ত্রণালয় হামদর্দ বিশ^বিদ্যালয় বাংলাদেশে ইউনানী চেয়ার হিসেবে প্রেরণ করেন দেশটির প্রখ্যাত ইউনানী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মনোয়ার হোসেন কাজমীকে।
২০২২ সালে ড. হাকীম মো. ইউছুফ হারুন ভূঁইয়া বিপুল ভোটে বাংলাদেশ আয়ুর্বেদিক মেডিসিন ম্যানুফেকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনে সভাপতি নির্বাচিত হন। তার বলিষ্ঠ উদ্যোগের কারণে ইউনানী আয়ুর্বেদিক খাতকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউছুফের নেতৃত্বে গঠিত হয় ইউনানী আয়ুর্বেদিক ও হোমিওপ্যাথিক সেল। এ খাতের জন্য এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
এভাবে বর্ণাঢ্য কর্মতৎপরতায় মানুষের কল্যাণে নির্ঘুম কাজ করে যাচ্ছে হামদর্দ বাংলাদেশ। ১১৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর শুভক্ষণে সকল শুভানুধ্যায়ী, সেবাগ্রহণকারী এবং দেশবাসীর প্রতি নিরন্তর কৃতজ্ঞতা ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছে হামদর্দ কর্তৃপক্ষ।
লেখক: আমিরুল মোমেনীন মানিক
পরিচালক তথ্য ও গণসংযোগ, হামদর্দ বাংলাদেশ