শিশুর ডায়রিয়ায় ঘরোয়া চিকিৎসা
অধ্যাপক ডা. মনজুর হোসেন
প্রকাশ: ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
শিশুর ডায়রিয়ায় ঘরোয়া চিকিৎসা
পায়খানা লক্ষণীয়ভাবে নরম বা তরল হলে এবং শিশু স্বাভাবিক অভ্যাসের চেয়ে বেশি মলত্যাগ করলে তাকে ডায়রিয়া বলে। ডায়রিয়া হলে পানিশূন্যতা বা ডিহাইড্রেশন দেখা দেয়। এ পানিশূন্যতা রোধ করার জন্য খাবার স্যালাইন খাওয়াতে হয়। ডায়রিয়া হলে হঠাৎ করে শিশুর ওজন কমে যায়, পানি পিপাসা পায়, দুর্বল হয়ে যায়, খিটখিটে মেজাজ হয়, চোখ কোটরে ঢুকে যায়, জিহ্বা শুকিয়ে যায়, মাথার চাঁদি বা তালু ডেবে যায় এবং চামড়ার স্থিতিস্থাপকতা কমে যায়-ফলে চামড়া টেনে ছেড়ে দিলে আস্তে আস্তে সমান হয় অথবা অনেকক্ষণ চামড়ায় ভাঁজ থাকে। কয়েক ঘণ্টা যদি শিশুর প্রস্রাব করা বন্ধ থাকে তাহলে বুঝতে হবে শিশু মারাত্মক পানিশূন্যতায় ভুগছে। ডায়রিয়ার জন্য সৃষ্ট পানিশূন্যতা রোধ করাই হলো ডায়রিয়ার প্রাথমিক চিকিৎসা।
* স্যালাইন তৈরি করার নিয়ম
▶ বাজারে এক লিটার বা আধা লিটার খাবার স্যালাইন তৈরি করার জন্য লবণ-পানির শরবতের প্যাকেট পাওয়া যায়। প্যাকেটে মুদ্রিত নির্দেশ অনুযায়ী স্যালাইন প্রস্তুত ও সংরক্ষণ করুন।
▶ আধা লিটারের প্যাকেট আধা লিটার বা ৫০০ মিলি ফুটানো ঠান্ডা পানিতে স্যালাইন মিশাতে হবে। কোনোক্রেমেই গরম পানিতে মেশানো যাবে না।
▶ চিনি-গুড়ের স্যালাইন : ৮ চা চামচ চাল, চিনি-গুড়; ১ চা চামচ লবণ ও ১ লিটার ফুটানো ঠান্ডা পানি দিয়ে বাসায় এ স্যালাইন তৈরি করা হয়।
▶ চালের স্যালাইন : ৮ চা চামচ চালের গুঁড়া, ১ লিটারের চেয়ে সামান্য বেশি পানিতে ভালোভাবে মিশিয়ে নিতে হবে। তারপর চুলার ওপর রেখে গরম করতে হবে এবং চামচ দিয়ে নাড়তে হবে। ৫ থেকে ৭ মিনিট ফুটানোর পর চুলা থেকে নামিয়ে ১ চা চামচ লবণ মিশাতে হবে। ঠান্ডা হলে খেতে দিতে হবে।
▶ যদি চালের গুঁড়া না থাকে তাহলে দুই মুঠ চাল ভালোভাবে ধুয়ে পিষাতে হবে এবং চালের গুঁড়ার স্যালাইনের মতো একই পদ্ধতিতে স্যালাইন তৈরি করতে হয়।
(এক চা চামচ ৫ মিলি. তরল ধারণক্ষম এবং লবণ-চিনি মাপার সময় চামচের কিনারার সমান করে চাকু অথবা আঙুল দিয়ে সমতল করে নিতে হবে। একপোয়া কাচের পানির গ্লাস ২৪০ মিলি. পানি ধারণ করে তাই সাড়ে চার গ্লাস পানি ১ লিটারের চেয়ে সামান্য বেশি। ১ লিটার সমান ১০০০ মিলি. বা ১৭ ছটাক। ছোট কোকাকোলার বোতল ২৫০ মিলি. পানি ধারণ করে।)
* মনে রাখবেন
কখনো খাবার স্যালাইন চোখের পানির চেয়ে লবণাক্ত হবে না। একবার খাবার স্যালাইন তৈরি করার পর তা ১২ ঘণ্টার মধ্যে ব্যবহার করতে হবে। ১২ ঘণ্টা পর তৈরি স্যালাইন ফেলে দিন, ব্যবহার করবেন না। অনেক মায়েরা শিশুকে দুধের পাশাপাশি মিশ্রির পানি দেয় অথবা দুধের সঙ্গে মিশ্রির পানি মিশিয়ে দেয়। মিশ্রি খাওয়ানোর ফলে শিশুর পাতলা পায়খানা হতে পারে এবং ডায়রিয়ার সময় দুধ বন্ধ করে কখনো বার্লি দিতে নেই। বার্লিও ডায়রিয়ার অবনতি করতে পারে এবং পুষ্টিহীনতা করতে পারে।
* স্যালাইন খাওয়ানোর পদ্ধতি
২ থেকে ৩ মিনিট পর পর অল্প অল্প করে স্যালাইন চামচ অথবা কাপে করে খাওয়াতে হয়। শিশু যদি একবারে বেশি খেতে চায় তাহলে বেশিই খেতে দিতে হয়-এতে ক্ষতি হয় না। প্রতিবার পাতলা পায়খানা করার পর ১০০ মিলি. বা আধা চায়ের কাপ স্যালাইন খেতে দিন। বেশি চাইলে বেশি খেতে দিতে হবে। যদি বাচ্চা বমি করে তবে প্রতি তিন মিনিট পর পর ২ চায়ের চামচ করে স্যালাইন খাওয়াতে থাকুন। সাধারণত স্যালাইন খাওয়ানো শুরু করার এক থেকে দুঘণ্টার মধ্যে বমি করা বন্ধ হয়ে যায়। শিশুর বয়স ৯ মাসের কম হলে খাবার স্যালাইন ব্যবহারের সঙ্গে সঙ্গে বুকের দুধ অবশ্যই খাওয়াতে হবে। যদি শিশু বুকের দুধ না খায় তবে খাবার স্যালাইন খাওয়ানোর পরপরই দ্বিগুণ পরিমাণ ফুটানো ঠান্ডা পানি খেতে দিন।
* স্যালাইন কীভাবে খেতে দেবেন
চামচ অথবা কাপে করে অল্প অল্প করে খেতে দিন। পানিশূন্যতার কারণে অনেক শিশু পিপাসার্ত থাকে। তার তৃষ্ণা নিবারণের জন্য যথেষ্ট স্যালাইন খেতে দিন।
* যদি বাচ্চা বমি করে
প্রতি মিনিটে চায়ের চামচের এক চামচ করে স্যালাইন খাওয়ান। একবারে বেশি খেতে চাইলে বেশি খেতে দিন। বেশি খাওয়ার পরপরই যদি বমি করে তাতে ঘাবড়ানোর কিছু নেই, সাধারণত স্যালাইন খাওয়ানো শুরু করার এক থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে বমি করা বন্ধ হয়ে যায়।
* ডায়রিয়া চলাকালীন শিশুর খাদ্য
বয়স অনুযায়ী মায়ের দুধ, নরম ভাত, সুজি, চিড়া, আলু, দই, কলা, পেঁপে, আনারস, ডাবের পানি, অন্যান্য নরম ও সহজে হজম হয় এমন খাবার খেতে দিন। ডায়রিয়া চালাকালীন শিশুকে স্বাভাবিক খাবার খেতে দিতে হয়। তবে শাক এবং আঁশযুক্ত খাবার না খাওয়ানোই ভালো। মায়ের দুধ, পাতলা গরুর বা টিনের দুধ, নরম ভাত, সুজি, চিড়া, আলু, দই, কলা, পেঁপে, আনারস, ডাবের পানি, ফলের রস ও অন্যান্য নরম ও সহজে হজম হয় এমন খাবার খেতে দিতে হয়।
* কখন হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেবেন
▶ স্যালাইন খাওয়ানো শুরু করার চার থেকে আট ঘণ্টার মধ্যে যদি পানিশূন্যতা না সারে অথবা শিশুর প্রস্রাবের মাত্রা স্বাভাবিক না হয়।
▶ স্যালাইন খাওয়ানো শুরু করার দুঘণ্টা পরও যদি শিশু ঘণ্টায় চারবারের চেয়ে বেশি বমি করে।
▶ স্যালাইন খাওয়ার পরও যদি পেট ফেঁপে ওঠে বা হাত-পা খিঁচুনি হয় বা শ্বাসকষ্ট হয়।
লেখক : শিশুরোগ ও শিশু হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, সাবেক অধ্যাপক ও পরিচালক, ঢাকা শিশু হাসপাতাল।