ডেঙ্গুর ভাইরাসবাহী এডিস মশা কামড় দেওয়ার পর সুস্থ শিশুর শরীরে এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ে। এর চার থেকে দশ দিনের মধ্যে উপসর্গ দেখা দেয়। ডেঙ্গু যেহেতু ভাইরাসজনিত রোগ, তাই এ রোগে জ্বরের তাপমাত্রা সাধারণত ১০১ থেকে ১০৩ ডিগ্রি ফারেনহাইট হতে পারে। তবে ডেঙ্গু হলেই যে তীব্র জ্বর থাকবে, এমনটা নয়।
ডেঙ্গুর এ জ্বরকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়-১. ফেব্রাইলফেজ : শিশুর ডেঙ্গুজ্বর দুই থেকে তিন দিন বা এর চেয়ে বেশি সময় স্থায়ী হলে। ২. অ্যাফেব্রাইল ফেজ : এ সময় শিশুর আর জ্বর থাকে না। সাধারণত এর সময়কাল থাকে দুই-তিন দিন। ৩. কনভালসেন্ট ফেজ : যখন শিশুর শরীরে র্যাশ দেখা যায়। এর সময়কাল থাকে চার-পাঁচ দিন। অ্যাফেব্রাইল ফেজে অভিভাবকদের সবচেয়ে বেশি সতর্ক থাকতে হবে। কারণ, এ ক্রিটিক্যাল ফেজে শিশুর জ্বর বা শরীরের তাপমাত্রা কমে যাওয়ার পর শিশু সংকটপূর্ণ অবস্থায় চলে যেতে পারে। এ সময়ে শিশুর শরীরে প্লাজমা লিকেজ হয় এবং তা শরীরের বিভিন্ন অংশে জমা হয়ে থাকে। এ কারণে রোগীর পেট ফুলে যায় বা রক্তক্ষরণের মতো সমস্যা দেখা দেয়; যার কারণে শিশুর ডেঙ্গু শক সিনড্রোম হতে পারে। তাই জ্বর সেরে যাওয়ার দুই থেকে তিন দিন শিশুকে সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখা প্রয়োজন।
শিশুরা এ সময় স্বাভাবিক চঞ্চলতা ভুলে প্রচুর কান্নাকাটি করে থাকে, নিস্তেজ হয়ে পড়ে। শিশুর মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষুধামান্দ্য দেখা দেয়, কিছুই খেতে চায় না, বমি বমি ভাব হয়। ছয় থেকে আট ঘণ্টার মধ্যে শিশুর প্রস্রাব না হওয়া ডেঙ্গুর মারাত্মক লক্ষণগুলোর একটি। শরীরে লালচে র্যাশ দেখা দিতে পারে। এছাড়া মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা, পেটে ব্যথা হতে পারে। চোখ লাল হয়ে যাওয়া, কাশি বা শ্বাসকষ্ট হতে পারে। এ লক্ষণগুলো সাধারণত অ্যাফেব্রাইল স্তরে বেশি হয়ে থাকে। পরিস্থিতি গুরুতর হলে, ডেঙ্গুর কারণে শিশুর শকে যাওয়ার অবস্থা হলে তার পেট ফুলে যেতে পারে বা শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে যেমন-রক্তবমি হওয়া, মলের সঙ্গে বা নাক দিয়ে রক্ত পড়া।
মেডিকেল পরীক্ষায় যদি শিশুর ডেঙ্গু ধরা পড়ে, তাহলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে ডেঙ্গু হলেই যে শিশুকে হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা দিতে হবে তা নয়। বাড়িতে রেখে নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে শিশুকে সম্পূর্ণ সুস্থ করে তোলা সম্ভব। শিশুর মধ্যে গুরুতর লক্ষণ প্রকাশ পেলে চিকিৎসকরাই তাকে হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দেবেন।
শিশুর মধ্যে ডেঙ্গুর প্রাথমিক লক্ষণগুলো দেখা দিলে চিকিৎসকরা রক্তের পরীক্ষা দিয়ে থাকেন। এগুলো হলো-কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট (সিবিসি), ডেঙ্গু এনএস ওয়ান অ্যান্টিজেন, এসজিপিটি ও এসজিওটি। এসব পরীক্ষায় ডেঙ্গু শনাক্ত হলে প্রতিদিন একবার সিবিসি পরীক্ষার মাধ্যমে পরিস্থিতির উন্নতি নাকি অবনতি হচ্ছে, তা পর্যবেক্ষণ করা হয়।
শিশুর শরীরে যদি জ্বর থাকে, তাহলে পানি দিয়ে শরীর বারবার স্পঞ্জ করে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। শিশুর ডেঙ্গু শনাক্ত হলে বারবার তরল খাবার খাওয়ার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। শিশুকে পানি ও মায়ের বুকের দুধের পাশাপাশি বেশি পরিমাণে তরল খাবার, বিশেষ করে খাওয়ার স্যালাইন, ডাবের পানি, ফলের শরবত, সুপ খাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকরা। ডেঙ্গুর ধরন ও লক্ষণ বুঝে চিকিৎসকরা শিশুদের প্যারাসিটামল বা অন্যান্য ওষুধ দিয়ে থাকেন। রক্তচাপ অস্বাভাবিক থাকলে স্যালাইন দিয়ে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। এক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া প্রয়োজন। শিশুর শরীরে রক্তক্ষরণ শুরু হলে রক্ত দেওয়ারও প্রয়োজন হতে পারে। শিশুর রক্তে প্লাটিলেট যদি পাঁচ হাজার থেকে দশ হাজারের নিচে চলে আসে বা রক্তরক্ষণ হয়, তাহলে শিশুকে আইসিইউতে রেখে প্লাটিলেট দেওয়ার প্রয়োজন হয়। সাধারণত চারজন ডোনার থেকে এই প্লাটিলেট সংগ্রহ করা হয়। তাই শিশুর শারীরিক পরিস্থিতি গুরুতর হলে অন্তত রক্তের গ্রুপ মিলিয়ে কয়েকজন রক্তদাতাকে প্রস্তুত রাখতে হবে। রোগীর পরিস্থিতি গুরুতর হলে রক্ত পরীক্ষার পাশাপাশি বুকের এক্সরে, পেটের আলট্রাসনোগ্রাফি, ইলেকট্রোলাইটের মাত্রা পরিমাপ করা হয়। এছাড়া প্রস্রাব না হলে ক্রিয়াটিনিনের মাত্রাও দেখা হয়।
শিশুদের ফ্লুয়িড ম্যানেজমেন্ট ঠিকমতো না হলে ঝুঁকি বেড়ে যায়। দেরি হয়ে গেলে রোগীর পরিস্থিতি খারাপের দিকে চলে যায়। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে শিশুর মৃত্যুর পেছনে এটা একটা বড় কারণ। জ্বর এলে অভিভাবকরা দেরি করে হাসপাতালে আসছেন। শুরু থেকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না হওয়ায় রোগীর পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। তাই জ্বর হলে শিশুদের অতি দ্রুত হাসপাতালে আনার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।
ডেঙ্গু প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধের দিকে খেয়াল রাখা জরুরি। এক্ষেত্রে এডিস মশার উৎস ধ্বংস করতে হবে প্রথমে। এডিস মশা সাধারণত গৃহস্থালির পরিষ্কার পানিতে জন্মে থাকে; যেমন-ফ্রিজে জমে থাকা পানি, এসিতে জমে থাকা পানি, ফুলের টব, গাড়ির টায়ার বা ডাবের খোলে বৃষ্টির জমে থাকা পানি। তাই এডিস মশার লার্ভা জন্ম নিতে পারে এমন স্থানগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো নষ্ট করে ফেলতে হবে। বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। শিশুদের দিনে ও রাতে মশারির ভেতরে রাখতে হবে। বিশেষ করে নবজাতক শিশুকে সার্বক্ষণিক মশারির ভেতরে রাখতে হবে। ফুলহাতা জামা ও প্যান্ট পরিয়ে রাখতে হবে। এছাড়া হাসপাতালে কোনো শিশু যদি অন্য রোগের চিকিৎসাও নিতে আসে, তাহলে তাকেও মশারির ভেতরে রাখতে হবে। কারণ ডেঙ্গু আক্রান্ত কাউকে এডিস মশা কামড়ে পরে আবার অন্য কোনো সুস্থ শিশুকে কামড়ালে তার শরীরেও ডেঙ্গুর ভাইরাস ছড়িয়ে পড়তে পারে।
শিশুরা যে সময় বাইরে ছুটোছুটি বা খেলাধুলা করে, সে সময়টাতে তাদের শরীরে মসকুইটো রেপেলেন্ট অর্থাৎ মশা নিরোধীকরণ স্প্রে, ক্রিম বা জেল ব্যবহার করতে হবে। কয়েক ঘণ্টা পরপর এই রেপেলেন্ট প্রয়োগ করতে হবে।
ডা. সেলিনা সুলতানা : কনসালটেন্ট, নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার এবং চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড পেডিয়াট্রিক ডিপার্টমেন্ট, বেটার লাইফ হসপিটাল