Logo
Logo
×

ডাক্তার আছেন

শিশুদের ডেঙ্গু জ্বর হলে যা করবেন

Icon

ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমান

প্রকাশ: ১০ আগস্ট ২০২৩, ০১:১৩ এএম

শিশুদের ডেঙ্গু জ্বর হলে যা করবেন

ডেঙ্গু একটি ভাইরাসঘটিত রোগ। ডেঙ্গু ভাইরাসের মোট চারিটি প্রজাতি রয়েছে। DENV1 , DENV2, DENV3 & DENV4. এডিস মশা এ রোগের বাহক। কোনো মানুষকে ডেঙ্গু আক্রান্ত মশা কামড়ানোর ৩ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে সাধারণত ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ শুরু হয়। অর্থাৎ মানুষের শরীরের জীবাণু প্রবেশের পর সাধারণত ৩ থেকে ১৪ দিন পরে রোগের লক্ষণ দেখা দেয়।

ডেঙ্গু জ্বর হলে শরীরে কি সমস্যা হয়: প্রথমত ডেঙ্গু ভাইরাসে সংক্রমণের ফলে মানবদেহে রক্তবাহী শিরা ও ধমনিগুলো ভেতরের প্রলেপ (Endothelium) বা পর্দাটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ কারণে রক্তবাহী নালি থেকে রক্ত রস বেরিয়ে যায়। ফলে ব্লাড প্রেসার কমে যায় এবং আস্তে আস্তে শরীরে রক্ত প্রবাহের বিঘ্ন ঘটে, যেটাকে মেডিকেলের ভাষায় Shock বলা হয়।
 
দ্বিতীয়ত: প্লাটিলেট এবং শরীরের রক্ত জমাট বাধার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট উপাদানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় রক্তক্ষরণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
অর্থাৎ এ রোগের মূল সমস্যা ২টি-

১. শরীরের রক্ত রস কমে গিয়ে blood pressure কমে যাওয়া।
২. Platelets ও রক্ত জমাট বাধার উপকরণগুলো কমে গিয়ে রক্তক্ষরণ হওয়া। 

রোগের তীব্রতার ওপর নির্ভর করে ডেঙ্গু জ্বরকে বেশ কয়েক ভাগে ভাগ করা হয়-
 
১. সাধারণ ডেঙ্গু জ্বর: জ্বর, শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা, চোখের পিছনে ব্যথা এ রোগের অন্যতম লক্ষণ।

২. Dengue Hemorrhagic feve: এ অবস্থায় রোগীর রক্তরস রক্তনালী থেকে বের হয়ে যায়। ফলে উপরোক্ত লক্ষণের সঙ্গে রোগীর ব্লাড প্রেসার কমে যায়।

৩. Dengue shock syndrome (ডেঙ্গু শক সিনড্রোম): এ অবস্থাটি ডেঙ্গু হামরিজিক ফিভারের একটি ভয়াবহ রূপ। এখানে রোগীর ব্লাড প্রেসার এতটাই কমে যায় যে রোগীর শরীরের কোষগুলোতে অক্সিজেন সরবরাহ বিঘ্ন ঘটে। 

৪. Expanded dengue syndrom: এটি ডেঙ্গু জ্বরের এর সবচেয়ে ভয়ংকর রূপ। এখানে মস্তিষ্ক, হৃদপিণ্ড, লিভার, কিডনি সবকিছুই ডেঙ্গু ভাইরাস দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে।

ডেঙ্গু জ্বরের তিনটি ধাপ রয়েছে: ডেঙ্গু জ্বর সাধারণত দুই থেকে সাত দিন স্থায়ী হয়। এ সময় শরীরে লাল লাল দাগ, শরীর ব্যথা, মাথাব্যথা থাকে। 

Critical phas: এই phaseটি অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। এই phaseটি সাধারণত শুরু হয় জ্বরের চতুর্থ অথবা পঞ্চমতম দিন থেকে এবং জ্বর ভালো হয়ে যাওয়ার পরবর্তী ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা পর্যন্ত স্থায়ী হয়। 

Convalescent phase বা recovery phase: critical phase শেষ হওয়ার দুই থেকে তিন দিনের মধ্যেই রোগী আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে যায় এই সময়কে রিকভারি ফেস বলে ।

ডেঙ্গু জ্বরের পরীক্ষা সমূহ: ডেঙ্গু জ্বরে কী কী পরীক্ষা করবেন এবং কোন দিন কী পরীক্ষা করবেন এটা জানা খুবই প্রয়োজন। এ সম্পর্কে না বুঝে পরীক্ষা করলে অনেক সময় পরীক্ষার রেজাল্ট নেগেটিভ হয় ফলে রোগ নির্ণয় কঠিন হয়ে যায়।
ডেঙ্গু জ্বরের সাধারণত নিম্ন বর্ণিত পরীক্ষাগুলো করা হয়।
১. NS 1 
২. IgM & IgG for dengue
৩. CBC
৪. Platelet  count, 
৫. SGPTএবং SGOT 

NS 1: এটা সাধারণত জ্বর আরম্ভ হওয়ার দিন থেকে শুরু করে প্রথম তিন দিন পজিটিভ হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে পাঁচ থেকে সাতদিন পর্যন্ত পজিটিভ হতে পারে।
 
IgM for dengue: এই পরীক্ষাটি জ্বর শুরুর পাঁচ দিন পর অর্থাৎ জ্বরের ষষ্ঠ দিনে থেকে শুরু করে প্রায় মাসাধিক পজেটিভ থাকে।

IgG for dengue: এই পরীক্ষাটি পজিটিভ হলে বর্তমানে নয় বরং পূর্বে কখন ডেঙ্গু হয়েছিল এটার ইঙ্গিত বহন করে।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে জ্বরের প্রথম তিনদিন NS 1 পজিটিভ অথবা ষষ্ঠ দিন থেকে IgM পজিটিভ হবে কিন্তু জ্বরের চতুর্থ এবং পঞ্চম দিনের মধ্যে NS 1 এবং IgM দুইটি test নেগেটিভ হওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি থাকে। তাই এ সময়ে পরীক্ষা করলে ডেঙ্গু শনাক্তকরণ কঠিন হয়ে যায়।

মনে রাখতে হবে উপরোক্ত পরীক্ষাগুলো নেগেটিভ হলেই ডেঙ্গু হয় নাই এটি শতভাগ নিশ্চিত করে বলা যাবে না। কারণ কোনো পরীক্ষায় ডেঙ্গু শনাক্তকরণে ১০০ ভাগ নিশ্চয়তা প্রদান করে না।

CBC: ডেঙ্গু জ্বরে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। ক্লিনিক্যাল অ্যাসেসমেন্টের পাশাপাশি CBC তে Total Count, neutrophil count, platelet count এবং Hematocrit দেখেই সাধারণত রোগীর অবস্থা কেমন আছে তা বিবেচনা করা হয়। 

CBC রিপোর্টে হেমাটোক্রিট বেড়ে গেলে, WBC কাউন্ট, নিউটোফিল কাউন্ট ও প্ল্যাটলেট কাউন্ট কমে গেলে অথবা SGPT এবং SGOT পরিমাণ বেড়ে গেলে রোগীর অবস্থার অবনতি হচ্ছে বলে বিবেচনা করা হয়। আবার রিপোর্টে এর বিপরীত চিত্র হলে রোগীর অবস্থার উন্নতি হচ্ছে বলে বিবেচনা করা হয়।

ডেঙ্গু রোগীর clinical assessment বা শারীরিক মূল্যায়ন: 

clinical assessment বলতে বোঝানো হয় Lab পরীক্ষা ছাড়া চিকিৎসকরা রোগীদের Physical condition দেখে রোগী সম্পর্কে যে মূল্যায়ন করে থাকেন তাকেই ক্লিনিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট বলে। সব রোগের ক্ষেত্রে clinical assessment গুরুত্বপূর্ণ তবে ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে ক্লিনিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট অনেক বেশি গুরুত্ব বহন করে তাই শুধু ল্যাব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডেঙ্গু রোগী ভালো আছে এটি বলার অবকাশ নেই। 

ডেঙ্গু রোগের ক্ষেত্রে ক্লিনিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট করার সময় নিম্নের বিষয়গুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে।
১. General well being অর্থাৎ রোগীর শারীরিক অনুভূতি কেমন বা শারীরিকভাবে কেমন অনুভব করছেন বিশেষভাবে রোগীর অস্থিরতা আছে কিনা।
২. ব্লাড প্রেসার কেমন
৩. পেট ব্যথা বা বমি আছে কিনা
৪. শরীরের কোন স্থান থেকে রক্তক্ষরণ হচ্ছে কিনা।

সতর্কতা:
মনে রাখবেন ডেঙ্গু জ্বর হলে সব প্রকার জটিলতাসমূহ শুরু হয় জ্বরের শেষের ভাগে অথবা জ্বর ভালো হওয়ার পরে। এসময় হঠাৎ করে ব্লাড প্রেসার কমে রোগী শকে চলে যেতে পারে। তাই জ্বরের শেষ অংশে অথবা জ্বর ভালো হয়ে যাওয়ার পরবর্তী ২--৩ দিন রোগীকে নিবিড় পর্যবেক্ষণ রাখতে হবে।

মনে রাখতে হবে Platelets count ভাল আছে অথবা জ্বর নাই আর কোনো সমস্যা হবে না, এটা ভাববেন না। 

যদিও ডেঙ্গু জ্বর হলে অধিকাংশ রোগীর হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয় না। শুধু নিম্নলিখিত কারণে রোগীর ভর্তির প্রয়োজন হয়-

১. বাচ্চা অস্থির হলে।
২. Blood Pressure কমে গেলে।
৩. প্রচণ্ড পেট ব্যাথা / বমি হলে।
৪. পেটে বা বুকে পানি আসলে।
৫. Platelets count দ্রুত কমে গেলে।  
৬. রক্তক্ষরণ হলে।

হাসপাতালে ভর্তি রোগীকে কি চিকিৎসা দেওয়া হয়?

ভর্তিকৃত সব রোগীকে শিরায় স্যালাইন দেওয়ার মাধ্যমে ব্লাড প্রেসার মেইনটেইন করা এবং নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা মূল চিকিৎসা।

তাই শিশুদের ডেঙ্গু জ্বর হলেই আতঙ্কিত না হয়ে একজন শিশু বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে রেখে
* বেশি বেশি তরল খাবার খাওয়ান।
* পূর্ণ বিশ্রামে রাখুন।
* চিকিৎসক ভর্তি হতে পরামর্শ দিলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হবেন।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, শিশু বিভাগ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতাল, ঢাকা

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম