
প্রিন্ট: ১৭ এপ্রিল ২০২৫, ০১:০০ এএম
কামরাঙ্গীরচরে গণপিটুনিতে নিহত ২ সন্ত্রাসীর কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ ছিলেন ভুক্তভোগীরা

যুগান্তর প্রতিবেদন ও হাজারীবাগ (ঢাকা) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ১২:১৪ পিএম

রাজধানীর কামরাঙ্গীরচরে গণপিটুনিতে দুই চাঁদাবাজের মৃত্যুর পর সামনে আসতে শুরু করেছে তাদের অপরাধের নানা ফিরিস্তি। মৃত দুজনের বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় রয়েছে নানা অপরাধে অন্তত ১২টি মামলা। দীর্ঘদিন ধরে তাদের চাঁদাবাজি, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায় ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ ছিল দিনমজুরসহ খেটে খাওয়া নানা শ্রেণি পেশার মানুষ। রাজমিস্ত্রি, ইট-বালু-সিমেন্ট দোকানের শ্রমিক- সবাইকে চাঁদা দিতে হতো। এসব লোকদের আয়ের ওপর ভিত্তি করে ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদা নির্ধারণ করতো। চক্রের অন্যদের গ্রেফতারের দাবি জানিয়েছেন দীর্ঘদিন ধরে বঞ্ছনার শিকার এলাকাবাসী। ভুক্তভোগী, পুলিশ ও সরেজমিনে গিয়ে এসব তথ্য জানা গেছে।
বুধবার রাত ১১টার দিকে কামরাঙ্গীরচরের সিলেটিয়া বাজার এলাকায় গণপিটুনিতে মাসুদ (২৯) ও নাদিম (৩৫) নামে দুই চাঁদাবাজ নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় সোহাগ (২৮) নামে আরও একজন আহত হয়েছেন। তাকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়েছে।
ভুক্তভোগীরা জানান, গত ফেব্র“য়ারি মাসে মাসুদের নেতৃত্বে চাঁদাবাজ চক্রের সদস্যরা স্থানীয় চা দোকানী নুর মোহাম্মদের কাছে ২ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন। তিনি তখন তাদের ১ লাখ টাকা দেন। পরবর্তীতে ৭ মার্চ রাতে বাকি ১ লাখ টাকার জন্য গেলে তিনি দিতে না পারায় তাকে ছুরিকাঘাত করে গুরুতর আহত করা হয়। সে সময় তার স্ত্রী বাধা দিতে গেলে তাকেও ছুরিকাঘাতে আহত করা হয়। ওই ঘটনায় নুর মোহাম্মদ ৮ মার্চ মামলা করেন।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বুধবার রাত পৌনে ১০টার দিকে মামলার অন্যতম আসামি নাদিম, মাসুদ ও সোহাগসহ আরও ৫/৬ জন দুটি মোটরসাইকেলে করে বাজারে এসে পুনরায় দোকানিদের কাছ থেকে চাঁদা দাবি করে এবং মামলা তুলে নিতে চাপ সৃষ্টি করে। কথাকাটাকির একপর্যায়ে রাত সোয়া ১০টার দিকে তারা কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়। এ সময় মামলার বাদী ও তার শালা মনির হোসেনকে বেধরক মারধর ও ছুরিকাঘাতে গুরুতর আহত করা হয়। তখন উত্তেজিত জনতা ধাওয়া করে তাদের ধরে গণপিটুনি দেয়।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, নিহতদের মধ্যে নাদিম লালবাগ শহীদনগরের বাসিন্দা ও চাঁদাবাজ দলের প্রধান। তার বাবার নাম সুলতান। নিহত মাসুদের বাসা কামরাঙ্গীরচরের আচারওয়ালা ঘাট এলাকায়। তার বাবা সোনাই মিয়া কামরাঙ্গীরচর থানা যুবলীগের সাবেক সহ-সভাপতি বলে জানা গেছে। চক্রের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে আহত সোহাগ, পলাতক পাত্তি, ইমনসহ অজ্ঞাতনামা ৫/৬ জনের বাসা লালবাগ ও কামরাঙ্গীরচরসহ বিভিন্ন এলাকায়। এই চক্রটি লালবাগ-চকবাজার এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী পিচ্চি মনিরের ছত্রচ্ছায়ায় পরিচালিত হতো। ঘটনাস্থল থেকে ৪টি অবিস্ফোরিত ককটেল, একটি সুইচ গিয়ার, ধারালো অস্ত্র ও দুটি মোটরসাইকেল উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া দুটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায় তারা।
স্থানীয় ভুক্তভোগীদের সূত্রে জানা যায়, কিশোরগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলা থেকে ১০০ থেকে ১৫০ জন দিনমজুর, রাজমিস্ত্রি, ইট-বালু-সিমেন্ট দোকানের শ্রমিক-জোগালি সিলেটি বাজার এলাকায় কাজ করেন। দীর্ঘদিন ধরে নানা অজুহাতে এসব অসহায় মানুষদের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করে আসছিল নাদিম, মাসুদ ও সোহাগসহ একটি সংঘবদ্ধ সন্ত্রাসী চক্র। এসব ব্যক্তিদের আর্থিক অবস্থার উপর ৫০ হাজার থেকে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত চাঁদার পরিমাণ নির্ধারিত হতো। চাঁদা না দিলে অপহরণ, মারধর, হুমকি এবং মুক্তিপণ আদায় ছিল নিয়মিত ঘটনা। ভয়ে অনেকে চাঁদা দিতেন, আবার কেউ সাহস করে মামলা করেছেন চক্রের সদস্যদের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগীদের মধ্যে শহীদ সরদার, আক্তার সরদার, রফিকুল সরদার, আলী সরদার, কাজল সরদার ও কামাল সরদারসহ আরও অনেকে এসব সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন।
তারা অভিযোগে বলেন, দিনমজুরি করে কোনমতে কষ্টে তাদের সংসার চলে। এরপরও এই চাঁদাবাজ চক্র তাদের কাছ থেকে নানাভাবে চাঁদা ও মুক্তিপণ আদায় করেছে। সরকার পরিবর্তনের পর এ পর্যন্ত প্রায় অর্ধ কোটি টাকা নিয়েছে সন্ত্রাসীরা।
ভুক্তভোগী দুলাল সরদার জানান, রোজার আগে তার পরিচিত আক্তার সরদার ও কাজল সরদারকে জোর করে তুলে নিয়ে যায় ওই চক্র। এরপর নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে তাদের কাছে ৫ লাখ টাকা দাবি করা হয়। পরে একজনকে ১ লাখ এবং আরেকজনকে ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে ছাড়িয়ে আনেন তারা।
কামরাঙ্গীরচর থানার ওসি আমিরুল ইসলাম বলেন, ঘটনার সময় পরিস্থিতি উত্তপ্ত থাকায় পুলিশ চেষ্টা করেও জনতার রোষ থামাতে পারেনি। পরে সেনাবাহিনীর সহায়তায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। বর্তমানে এলাকায় যৌথ টহল জোরদার করা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এ ঘটনায় আহত চা দোকানীর শ্বশুর বাদী হয়ে একটি মামলা করেছে। এছাড়া মৃত্যুর ঘটনায় পুলিশ একটি মামলা করবে।
গ্যাং লিডার সজিব গ্রেপ্তার: সিলেটি বাজারে সংঘটিত হামলার ঘটনার পর সেনাবাহিনী অভিযান চালিয়ে অপরাধী গ্যাংয়ের মূলহোতা সাজিবকে আটক করেছে। বৃহস্পতিবার রাত ১০টার দিকে সাজিবের বাসায় তল্লাশি করে আলমারির ভিতরে লুকিয়ে থাকা অবস্থায় তাকে পাওয়া যায়। থানা সূত্রে জানা গেছে, রাতেই তাকে কামরাঙ্গীরচর থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।