পথেঘাটে বিক্রি হচ্ছে নিম্নমানের খোলা খাবার, হুমকির মুখে জনস্বাস্থ্য
মো. মাহবুবুর রহমান ভূঁইয়া, ডেমরা (ঢাকা)
প্রকাশ: ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১:১২ পিএম
খাদ্য সংশ্লিষ্ট কোনো নিয়মনীতি ও স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে রাজধানীর আনাচে-কানাচে অবাধে বিক্রি হচ্ছে খোলা খাবার। এসব খাবার খেয়ে ক্যানসারসহ বিভিন্ন কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে মানুষ। হুমকির মুখে পড়েছে জনস্বাস্থ্য। এদিকে নজরদারি না থাকায় ছোট-বড় ও মাঝারি খাবার হোটেলগুলোতে এখনো নোংরা পরিবেশে রান্নাবান্না ও খাবার পরিবেশন করা হচ্ছে।
সরেজমিন দেখা গেছে, দিনে দিনে রাজধানীর অধিকাংশ এলাকায় সড়ক ও ফুটপাত, স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসার সামনে, বিভিন্ন স্টেশন, মাঠ ও খোলা জায়গায় বেড়েছে খোলা খাবারের দোকান। এসব ‘স্ট্রিট ফুড’ দামে সস্তা ও সহজলভ্য বলে এলাকার দোকান ও টঙগুলো ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তবে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অধিকাংশ খোলা খাবারেই রয়েছে অনেক ধরনের জীবাণু, যা স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ ও মরণঘাতী। খোলা ও বারবার পোড়া তেলে ভাজা তৈলাক্ত এসব খাবারে মরণঘাতী ক্যানসারের জীবাণু সৃষ্টি হয়। আর এসব খাবারের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশে ভয়ংকর জীবাণু রয়েছে, যা খালি চোখে দেখা যায় না। প্রায় ৯০ শতাংশ রাস্তার খাবারেই ই-কোলাই, সালমোনেলা ও ইস্ট মোল্ডের মতো মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর জীবাণু পাওয়া গেছে। এ জাতীয় খাবার খেলে ডায়রিয়া, আমাশয়, টাইফয়েড, হেপাটাইটিসসহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগ, আলসার ও হৃদরোগ ইত্যাদি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সরেজমিন আরও দেখা গেছে, ঘনবসতিপূর্ণ ঢাকার অনুন্নত এলাকায় শ্রমিক, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ অধ্যুষিত এলাকায় খোলা খাবারের দোকান ও নোংরা পরিবেশে হোটেলের সংখ্যা বাড়ছে। এসব এলাকায় শত শত ছোট-বড়-মাঝারি ও স্থায়ী-অস্থায়ী খোলা খাবারের দোকানসহ রাজধানীতে চার সহস্রাধিক হোটেল রয়েছে। আর নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষদের খোলা ও নোংরা পরিবেশেই এসব খাবারের দোকান ও হোটেলগুলো থেকে খাবার খেতে হচ্ছে। বিশেষ করে রাজধানীর মিরপুর, গুলিস্তান, পুরান ঢাকা, ধানমণ্ডি, নিউমার্কেট এলাকা, তেজগাঁও, মহাখালী, ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, খিলগাঁও, সবুজবাগ ও রামপুরা থানা এলাকাসহ ঘনবসতিপূর্ণ প্রায় সব এলাকা, ডেমরা-রামপুরা, ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের দু’পাশ, সব স্কুল-কলেজ ও মাদ্রাসাসহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মার্কেট, শপিংমল, বাজার, শিল্পকারখানা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সামনে অবাধে বিক্রি হচ্ছে স্ট্রিট ফুড বা খোলা খাবার। পাশাপাশি ওইসব এলাকায় নোংরা পরিবেশে অবাধে চলছে হোটেল রেস্তোরাঁ। স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও খাদ্য পরিদর্শকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি না থাকায় মশা-মাছি ও ধুলাবালুর মধ্যেই দেদার বিক্রি হচ্ছে এসব খাবার। যা মানুষকে ক্রমেই মৃত্যুর দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ বিষয়ে ঢাকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক (মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ) ডা. এসএম ইয়ার-ই-মাহবুব যুগান্তরকে বলেন, ভোজ্যতেলের অতিরিক্ত বা অনুপযুক্ত ব্যবহার স্বাস্থ্যকে গুরুতরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। সঠিক ধরনের তেল বেছে নেওয়া এবং সঠিক পরিমাণে ব্যবহার স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ঢাকা জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের মেডিকেল অফিসার জানান, রান্নার জন্য অতিরিক্ত পোড়া গরম তেল ব্যবহার করলে বিষাক্ত যৌগ (যেমন এক্রোলিন ও ফ্রি র্যাডিকাল) তৈরি হয় যা শরীরে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। ঢাকা জেলা সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ জিল্লুর রহমান মোবাইল ফোনে যুগান্তরকে বলেন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে প্রকাশ্যে খোলা খাবার খাওয়া, বিক্রি ও পরিবেশন চরম অন্যায়। এসব খোলা খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়ে মানুষ হাসপাতালে ভিড় জমায়। বর্তমানে রোগীদের অভিযোগ হাসপাতালে বেড ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসক সংকটের কারণে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হচ্ছে। অথচ রোগী বৃদ্ধি না হয়ে যদি খাদ্যাভ্যাসে সচেতনতা বৃদ্ধি পায় তাহলে রোগীর সংখ্যাই কমে যাবে। এক্ষেত্রে মানুষের মাঝে শুধু সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে যাতে পথেঘাটে কেউ খোলা খাবার না খায়।
ডেমরার সারুলিয়া জেনারেল হাসপালের ডা. শামীম মিছির যুগান্তরকে বলেন, চারদিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় নিম্নমানের খাবার হোটেল ও দোকানগুলোতে রান্নার কাজে ব্যবহার হচ্ছে অত্যন্ত নিম্নমানের কমদামি ভোজ্যতেল। এসব বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কোনো তদারকি নেই।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের (ঢাকা মেট্রোপলিটন) নিরাপদ খাদ্য অফিসার মেহরীন যারীন তাসনিম মোবাইল ফোনে বলেন, ঢাকার অধিকাংশ এলাকায় ফুটপাতে বা পথেঘাটে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মারাত্মক জীবাণু বহনকারী খোলা খাবার বিক্রির বিরুদ্ধে বাজার কমিটির সঙ্গে সভা-সেমিনারের মাধ্যমে ব্যবসায়ীদের সচেতন করা হচ্ছে। আর কালি দিয়ে লেখাযুক্ত পেপারে খাবার পরিবেশন নিষিদ্ধ করাসহ ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান অব্যাহত রেখেছি আমরা।