‘হাসিনাকে জনসম্মুখে ফায়ার করা হলে মনে হয় আমি শান্তি পাব’
তারেক রহমান, উত্তরা পশ্চিম (ঢাকা) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৩৯ পিএম
মা ফাতেমাতুজ জোহরা বিকালেও জানতেন না আদরের সন্তানকে হয়তো শেষবারের মতো নিজ হাতে ভাত খাইয়ে দিচ্ছেন। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার খবরে রাজপথে যখন আনন্দ মিছিল আর উৎসবের আমেজ বইছিল; তখন মায়ের হাতের খাবার শেষ না করেই আনন্দ মিছিলে যোগ দিয়েছিল শহিদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র আব্দুল্লাহ বিন জাহিদ (১৭)। কিন্তু সেই মিছিল থেকে সে আর মায়ের বুকে ফিরতে পারেনি। শহিদ হয়েছে পুলিশের গুলিতে।
শুক্রবার উত্তরখানে শহিদ আব্দুল্লাহর বাড়িতে খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা যায়, ছেলের শোকে কাতর হয়ে অশ্রু ফেলছেন মা ফাতেমাতুজ জোহরা। পুলিশের গুলিতে নিহত ছেলের লাশের কথা বলতে গিয়ে ফাতেমাতুজ জোহরা যুগান্তরকে বলেন, খুনিরা আমার ছেলেকে দুইটা গুলি করছে। একটা ছেলের গলায় লাগছে আর অন্যটা পিঠে লাগছে। ডাক্তাররা গলার গুলিটা দেখেছে। কিন্তু পিঠে যে গুলি লাগছে এটা দেখারও তারা সময় পায়নি। তিনি বলেন, সেদিন (৫ আগস্ট) রাত ৮টা ১০ মিনিটে একটা অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন দিয়ে জানায়, আব্দুল্লাহর গুলি লাগছে তাড়াতাড়ি উত্তরার মহিলা মেডিকেলে আসেন। এটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমি পাগলের মতো হাসপাতালে ছুটে যাই। সঙ্গে তখন আমার মা, ভাই, ছোট ছেলে জিসানও ছিল।
তিনি জানান, হাসপাতালে গিয়ে দেখি একটা বেডের ওপর আমার আব্দুল্লাহকে ওরা শুইয়ে রাখছে। ওর পরনে গেঞ্জি আর ট্রাউজার ছিল। হাসপাতালের কাপড় দিয়ে ওপর মুখ ঢাকা ছিল আর পায়ে ছিল সাদা গজ কাপড় বাঁধা। তখনই আমি বুঝেছি আমার বাবাটা আর নেই।
ডাক্তাররা আমাকে জানায়, ওর গলার রগ, খাদ্যনালি ছিঁড়ে গেছে। লাশ বাসায় এনে গোসল করানোর সময় আব্দুল্লাহর পিঠেও গুলির একটা ছিদ্র পাই। ডাক্তাররা ওটা দেখারও সময় পায়নি, রক্ত কিছুতেই বন্ধ করতে পারছিল না।
ফাতেমাতুজ জোহরা আরও জানান, সন্ধ্যা ৭টার দিকে মোবাইলের নেট চালু করে একটা ভিডিওতে আমি জানতে পারি এয়ারপোর্টে নাকি পুলিশ খুব গুলি করেছে। তখন আমি আব্দুল্লাহকে কল দিই কিন্তু ও ফোন ধরেনি। তিনি বলেন, আব্দুল্লাহ যদি কখনো আমাকে ভয় পেত, তখন দেখতাম ওর ঠোঁট দুইটা সাদা হয়ে যেত। আমি যখন হাসপাতালে গিয়ে ওর মুখের কাপড় ওলটাই তখন দেখি আমার আব্দুল্লাহর ঠোঁটগুলো সাদা হয় গেছে। আমার শুধু মনে হয়, মৃত্যুর আগে ও মনে হয় জানতে চাইছিল আমার আম্মু কই! আমি যদি একবার শুধু ওর কথাটা শুনতে পারতাম; ওর শেষ কথাটা। তিনি বলেন, আমি আর আমার ছোট ছেলে (জিসান) এখন জীবন্ত লাশ হয়ে গেছি। আমাদের জীবনের হাসি-দুঃখ সব শেষ হয়ে গেছে।
হাসপাতালে নেওয়ার পর আব্দুল্লাহ কিছুক্ষণ বেঁচে ছিল জানিয়ে যুগান্তরকে তিনি জানান, হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার তিন-চার মিনিট পর্যন্ত আমার বাবাটা খুব কষ্ট করে কথা বলেছে। ও (আব্দুল্লাহ) নিজে নার্সদের আমার নম্বর দিয়ে নাকি বলেছে, আমি বাঁচব না, আর বাঁচব না। আপনারা আমার আম্মুকে একটু ফোন দেন। এই কথাগুলো বলতে বলতেই আমার আব্দুল্লাহ দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে। সেদিনের সেই দুপুরের কথা বলতে গিয়ে শহিদ আব্দুল্লাহর মা বলেন, ওইদিন আমরা সবাই আমার ভাইয়ের বাড়িতে ছিলাম। দুপুরের খাবার খেতে সেদিন চারটা বেজে গিয়েছিল। তখন আব্দুল্লাহ আমাকে বলে, আম্মু তুমি আমারে একটু খাইয়ে দাও না। তখন ওকে আমি ভাত খাইয়ে দিছি। তিনি জানান, ভাত খাওয়ার সময় আব্দুল্লাহ মোবাইল টিপছিল। খাবার শেষ না হতেই আব্দুল্লাহ আমাকে বলে-আম্মু আমি একটু নিচে (এয়ারপোর্টের ওদিকে) যাই। আমি বুঝতে পারছিলাম ও এয়ারপোর্টে মিছিলে যাবে। আমি বাধা দেইনি। সঙ্গে আমার ভাইও যায়। সন্ধ্যার আগেই ওর মামা (আমার ভাই) বাসায় ফিরে এসে জানায়, আব্দুল্লাহ নাকি ওর বন্ধুদের সঙ্গে ফিরবে। তখন ওর নম্বরে কল দিলে ফোন ধরে আব্দুল্লাহ আমাকে জানায়, আম্মু আমি আধা ঘণ্টার মধ্যে আসছি। ফাতেমাতুজ জোহরা বলেন, আমার বাবাটার এই আধা ঘণ্টা আজও শেষ হয়নি!
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আব্দুল্লাহর অংশগ্রহণের ব্যাপারে মা যুগান্তরকে জানান, আব্দুল্লাহ শুরু থেকেই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ১৯ জুলাই বিকালে যখন উত্তরায় গোলাগুলি হলো, তখন আব্দুল্লাহ উত্তরার আজমপুরে স্বপ্ন সুপারশপে আটকা পড়েছিল। আমার ছেলের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এখনো ওর সর্বশেষ পোস্ট ‘একদফা দাবি’ দেওয়া আছে।
সন্তানের দাফন-কাফনের ব্যাপারে ফাতেমাতুজ জোহরা বলেন, অ্যাম্বুলেন্স না থাকায় হাসপাতাল থেকে ওর লাশ দক্ষিণখানের বাসায় আনতে আনতে রাত সাড়ে এগারোটা বেজে যায়। রাত দুইটায় আব্দুল্লাহর প্রথম জানাজায় তিন-চারশ মানুষ আসে। রাতেই আব্দুল্লাহর লাশ নিয়ে আমরা গ্রামের বাড়িতে রওয়ানা দিই। পরদিন দুপুরে আমার ছেলেকে কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর থানার বরশিকোড়ায় আমাদের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে শহিদ জননী বলেন, শেখ হাসিনা যেমন মানুষকে মারছে, ওরকম জনসম্মুখে এনে যদি ওকে ফায়ার করা হয় তাহলে মনে হয় আমি শান্তি পাব। ওর প্রশাসনে যারা জড়িত সবাইকে ওইভাবে শাস্তি দিলে আমি শান্তি পাব। তিনি বলেন, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বলেন, আর ফাঁসি বলেন সেটা হবে না। ওরা যেভাবে গুলি চালিয়ে মানুষকে মারছে ঠিক ওইভাবে ওদেরকে মারলে মনে হয় আমার ছেলের হত্যার ন্যায়বিচার পাব।
একজন শহিদের মা হিসেবে ভবিষ্যৎ বাংলাদেশকে কেমন দেখতে চান এমন প্রশ্নে শহিদ আব্দুল্লাহর মা বলেন, ওরা (শহিদরা) যেভাবে বাংলাদেশকে চেয়েছে-কোনো দুর্নীতি থাকবে না, চাকরিতে বৈষম্য থাকবে না। যোগ্যতা অনুযায়ী যদি আমার ছেলে পিয়নও হয় তাতে আমার কোনো কষ্ট নেই। কিন্তু দুর্নীতি-অনিয়ম করে কেউ বড় পদে বসে যাবে এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে গিয়েই আমার ছেলে লাশ হয়েছে। বাংলাদেশটাকে আমি ঘুস-দুর্নীতিমুক্ত দেশ হিসাবে দেখতে চাই। রাষ্ট্র যেন চব্বিশের শহিদদের সর্বোচ্চ মূল্যায়ন করে এ আহ্বান জানিয়ে ফাতেমাতুজ জোহরা বলেন, শুধু আমার ছেলে নয়, চব্বিশে জীবন দেওয়া সব শহিদকেই এ দেশের মনে রাখতে হবে। ওরা এই দেশটাকে সুন্দর দেখতে চেয়ে জীবন দিয়েছে। রাষ্ট্রের উচিত শহিদকে সর্বোচ্চ মূল্যায়ন করা। পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া শহিদ আব্দুল্লাহর অসুস্থ ছোট ভাই জিসানের দাবি, আমার ভাইকে যারা গুলি করে মারছে, আমি তাদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।