আশুলিয়ায় চাঞ্চল্যকর ট্রিপল মার্ডার
সৎছেলেকে হত্যার পরিকল্পনা এঁটে স্বামী-সন্তানসহ নিজেই খুন
উত্তরা পশ্চিম (ঢাকা) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:৫৫ পিএম
বাবা ও সৎমা কর্তৃক হত্যার শিকার থেকে নিজেকে বাঁচাতে সৎমায়ের ভাড়া করা খুনিকে ম্যানেজ করে বাবা, সৎমা ও চার বছর বয়সি সৎবোন জান্নাতুলকে খুন করেন হিমেল নামের তরুণ। শুধু তাই নয়, লোমহর্ষক তিন খুনের পর শয়ণ কক্ষে আগুন লাগিয়ে ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ারও চেষ্টা করেন তিনি।পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) ছায়াতদন্তে বেরিয়ে এসেছে ট্রিপল মার্ডারের এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।
মঙ্গলবার দুপুরে রাজধানীর উত্তরায় ঢাকা জেলা পিবিআই কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ট্রিপল মার্ডারের রহস্য উন্মোচন ও আসামি গ্রেফতারের বিষয়ে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানান পিবিআইয়ের ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার কুদরত-ই-খুদা।
জানা যায়, গত ১২ সেপ্টেম্বর (বৃহস্পতিবার) আশুলিয়ার উত্তর ভাদাইল গ্রামে নিজেদের ফ্ল্যাটে খুন হন ব্যবসায়ী মিজানুর রহমান বাচ্চু, তার ৪র্থ স্ত্রী স্বপ্না বেগম ও চার বছর বয়সি কন্যা জান্নাতুল। এ ঘটনায় ভিকটিম মিজানুর রহমান বাচ্চুর বোন লাবণ্য আক্তার বাদী হয়ে আশুলিয়া থানায় মামলা করলে হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনে ছায়াতদন্তে নামে পিবিআই।
সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার মো. কুদরই-ই-খুদা জানান, হত্যাকারী তানভীর হাসান হিমেল (২২) ভিকটিম মিজানুর রহমান বাচ্চুর প্রথম স্ত্রীর ঘরের সন্তান এবং অপর খুনি তরিকুল ইসলাম তারেক (২৮) ভিকটিমের ব্যবসায়িক পার্টনার ও বাড়ির ভাড়াটিয়া।
ঘটনার দিন সৎমা স্বপ্না বেগম ছোট বোন জান্নাতুলকে সঙ্গে নিয়ে স্কুলে গেলে সেই সুযোগে হিমেল ভাড়াটিয়া তরিকুলকে সঙ্গে নিয়ে মিজানুর রহমান বাচ্চুর বেড রুমে ঢুকে পড়েন এবং ঘুমন্ত মিজানুরকে মাথায় হাতুড়ি দিয়ে আঘাত ও পরে বালিশ চাপায় হত্যা করেন তারা।
পিবিআই পুলিশ সুপার বলেন, হত্যার পর বেডে শোয়ানো অবস্থায় খুনিরা মিজানুরকে চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়। এর ঘণ্টা-দুয়েক পর বোন জান্নাতুলকে নিয়ে সৎমা স্বপ্না বেগম বাসায় ফিরলে ভবনের চারতলার সিঁড়ি থেকে তাদেরকে ধরে নিয়ে রুমের ভেতর আটকায় ছেলে হিমেল ও ভাড়াটিয়া তরিকুল। এক পর্যায়ে তাদের মা-মেয়েকেও বালিশ এবং খেলনা পুতুল দিয়ে চেপে ধরে শ্বাসরোধে হত্যা করেন তারা।
সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই কর্মকর্তা বলেন, আসামিরা এই ট্রিপল মার্ডারের ঘটনা আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিতে চেয়েছিল। এজন্য তারা লাশগুলো বিছানার ওপর পাশাপাশি শুইয়ে রুমের ভেতর কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়।
তিনি বলেন, খুনিরা তখন রুমের বাইরে এসে লোহার দরজা ছিদ্র করে ভেতরের হ্যাজভোল্ট (লক) এমনভাবে লাগিয়ে দেয় যেন তা ভেতর থেকেই লাগিয়ে রাখা হয়েছে। পরে তারা নিজেরাই চিৎকার শুরু করলে আশপাশের অন্যান্য ভাড়াটিয়ারা ঘটনাস্থলে আসলে একই কায়দায় দরজা খোলেন তারা। পরে স্থানীয় থানা পুলিশ খবর পেয়ে লাশ উদ্ধার করে।
কুদরত-ই-খুদা বলেন, এই ঘটনার পর হিমেল ও তরিকুল দুজনেই আত্মগোপনে ছিলেন। গত ৪ অক্টোবর ঢাকার নবাবগঞ্জ এলাকার বারুয়াখালি থেকে আসামি তরিকুল ইসলামকে আমরা গ্রেফতার করি। রিমান্ডে তরিকুল হত্যাকাণ্ডে নিজের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করলে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত হাতুড়ি, পুতুল এবং সিজার (কাঁচি) জব্দ করা হয়।পরে অপর আসামি হিমেলকে আশুলিয়ার জিরাবো এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়।
আসামিদের দেওয়া তথ্যের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, আসামি হিমেল জানিয়েছে সম্পত্তিতে কোনো ওয়ারিশ বা অংশীদার না রাখতে তাকে হত্যার জন্য সৎমা স্বপ্না বেগম বাবা মিজানুর রহমান বাচ্চুকে রাজি করিয়েছিলেন। আর এই কাজে তরিকুলকে ভাড়া করেছিলেন। কিন্তু হিমেল সব জেনে যাওয়ায় উল্টো তরিকুলকে বাবার টাকা ও স্বর্ণালঙ্কারের লোভ দেখিয়ে সবাইকে হত্যার পরিকল্পনা করেন হিমেল।শেষ পর্যন্ত তরিকুলকে সঙ্গে নিয়ে কিলিং মিশন সম্পন্ন করেন হিমেল।
জানা যায়, নিজ ছেলের হাতে হত্যাকাণ্ডের শিকার মিজানুর রহমান এর আগে আরও তিনটি বিয়ে করেন। হিমেল তার প্রথম স্ত্রীর ঘরের সন্তান। প্রথম স্ত্রীকে ডিভোর্স দিলেও ছেলে হিমেলকে নিয়ে একই বাড়িতে থাকতেন ওই ব্যবসায়ী। পরে তিনি আরও দুটি বিয়ে করলেও সেসব স্ত্রীকেও ডিভোর্স দেন মিজানুর। সর্বশেষ স্বপ্না বেগমকে বিয়ে করে ঘর-সংসার করছিলেন তিনি। তার দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরেও বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন এক কন্যা থাকার কথা জানিয়েছে পিবিআই।