বুলেটে শেষ স্বপ্নসাধ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগেই চিরদিনের ছুটিতে সৈকত
মোহাম্মদপুর (ঢাকা) প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৮ জুলাই ২০২৪, ১০:০৫ পিএম
মাহামুদুর রহমান সৈকত। ফাইল ছবি
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির অপেক্ষায় ছিলেন সদ্য এইচএসসি পাশ করা তরুণ মাহামুদুর রহমান সৈকত (১৯)। কিন্তু বুলেটের আঘাতে ভর্তির আগেই চিরদিনের ছুটিতে চলে গেছেন। পার্থিব সব চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে এখন তিনি। পরিবারের স্বপ্নসাধ ধূলিসাৎ। কোটা সংস্কার আন্দোলন চলাকালীন ১৯ জুলাই বিকাল সাড়ে ৩টায় রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান সৈকত (১৯)। আকস্মিক বুকের ধন হারিয়ে মা-বাবা যেন নির্বাক, বড় দুই বোন নিস্তব্ধ, পরিবারে চলছে শোকের মাতম।
সৈকত ২০২৩ সালে মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন। ভর্তির জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাভুক্ত সাত কলেজে আবেদন করে রেখেছেন। কিন্তু ফল ঘোষণার আগেই বুলেটে প্রাণ গেছে তার।
ঘটনার দিন গুলিবিদ্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সৈকতকে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু বিধিবাম। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ব্যবস্থাপত্রে তার মৃত্যুর কারণ হিসাবে লেখা রয়েছে ‘গান শুট’।
টগবগে, উচ্ছল, স্বপ্নবাজ সন্তানকে হারিয়ে মা-বাবা যেন নির্বাক গেছেন। ভাইকে হারিয়ে দুই বোনও নিস্তব্ধ। সন্তান হারানোর বেদনায় মা কাঁদতে কাঁদতে দিনে কয়েকবার মূর্চ্ছা যাচ্ছেন। বাবা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখের পানি ফেলে শুধু বলেন, ‘ছেলের লাশ কাঁধে উঠাতে শক্তি পাচ্ছিলাম না। আল্লাহর কাছে এর বিচার চাই।’
কোটা আন্দোলনে রাজধানীর পরিবেশ ছিল উত্তপ্ত। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ওই দিন বিকাল ৪টায় কৌতূহলবশে বন্ধুদের সঙ্গে নূরজাহান রোডের মাথায় যান সৈকত। সড়কের অপরপ্রান্ত থেকে পুলিশ গুলি ছুড়ে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই মাটিয়ে লুটিয়ে পড়েন সৈকত, নিভে যায় প্রাণপ্রদীপ। দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
সৈকতের বাবা মাহাবুবুর রহমান জানান, সেদিন আমি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপে গ্রামের বাড়িতে ছিলাম। ঢাকায় খারাপ পরিস্থিতি দেখে ছেলেকে বারবার ফোন করি। আমার বুকের ধন একবার শুধু ফোন ধরে বলেছিল, সে বাসার পাশে আমার দোকানে বসে আছে। কিছুক্ষণ পর কয়েকবার ফোন করার পর অপরিচিত একজন ফোন রিসিভ করে বলে, আপনার ছেলে গুলিতে নিহত হয়েছে। দ্রুত সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চলে আসেন। ততক্ষণে বুঝে গেছি, আমার সব শেষ। আমার বুকের মানিক আর নেই, আমার দম বন্ধ হয়ে যায়। সন্দ্বীপ থেকে উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে ঢাকায় চলে আসি। ততক্ষণে আমার সন্তানের লাশ হাসপাতালের মর্গে পড়ে আছে।
সৈকতের বড় দুই বোন শাহরিনা আফরোজ ও সাবরিনা আফরোজ ভাইয়ের শোকে একেবারে চুপচাপ। সাবরিনা জানান, আমার ভাই আমাদের পুরো বাসা সবসময় মাথায় তুলে রাখত। আমরা হাসিখুশি একটি পরিবার ছিলাম। আমার সেই টগবগে ভাইকে পুলিশ গুলি করবে কেন? গুলি যদি করতেই হতো, ভাইয়ের হাতে বা পায়ে করত। তাহলেও তো আমার ভাইটা পঙ্গু হয়ে হলেও আমাদের সঙ্গে প্রাণে বেঁচে থাকত। হত্যাকারী যদি আমাদের সামনে এসে বলে আমার ভাইকে তিনি গুলি করেছেন। তাকে আমাদের কিছু বলার নাই। আমার ভাইকে তো আর ফিরে পাব না। আমার ভাই তো আর ঘরে ফিরে আসবে না। আমাদের সঙ্গে খেলবে না।