নিচতলায় স্বামী দোতলায় স্ত্রীর রক্তাক্ত লাশ
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২০ জুন ২০২৪, ১০:১৫ পিএম
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর একটি ভবনের নিচতলা থেকে স্বামী এবং দোতলা থেকে স্ত্রীর রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। নিহত দম্পতি শফিকুর রহমান (৬০) ও ফরিদা ইয়াসমিনকে (৫০) কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ওই দম্পতির ছেলে মো. ইমন পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি) এসআই হিসাবে কর্মরত আছেন।
বৃহস্পতিবার সকালে যাত্রাবাড়ীর কোনাপাড়ার পশ্চিম মোমেনবাগের আড়াবাড়ি বটতলার বাসা থেকে পুলিশ দুজনের লাশ উদ্ধার করে। স্বজন ও পুলিশের প্রাথমিক ধারণা, জমিসংক্রান্ত বিরোধের জেরে পূর্বপরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে।
পুলিশ জানিয়েছে, সকালে জাতীয় জরুরি সেবা নম্বর ৯৯৯-এর মাধ্যমে সংবাদ পেয়ে আড়াবাড়ি বটতলার ওই বাড়িতে যায়। সেখানে তারা বাসার নিচতলায় শফিকুরের লাশ দেখতে পান। তার গলা ও মাথায় ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন ছিল। এরপর দোতলায় একটি কক্ষে মশারির ভেতর স্ত্রী ফরিদার লাশ পাওয়া যায়। তার মাথা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে ধারালো অস্ত্রের আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। পরে তাদের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে পাঠানো হয়।
জানা গেছে, নিহত শফিকুর রহমান জনতা ব্যাংকের গাড়িচালক হিসাবে ২ বছর আগে অবসরে যান। পরিবার নিয়ে তিনি ওই এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছিলেন। সেখানে তিনি চারতলা ওই বাড়িও নির্মাণ করেছেন। নিচতলার এক পাশ এবং তিন ও চারতলা ভাড়া দেওয়া, তিনি নিজে দোতলায় থাকতেন। তার ছেলে পুলিশের বিশেষ শাখার (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) উপপরিদর্শক (এসআই) ইমন ও তার স্ত্রী একই বাসায় থাকেন। বুধবার রাতে ইমন দাদার বাড়ি ফেনী এবং তার স্ত্রী নিজের বাবার বাড়িতে চলে যান।
বৃহস্পতিবার দুপুরে ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, আড়াবাড়ি বটতলা এলাকার কফিল উদ্দিন ভূঁইয়া সড়কের ১৭৫ নম্বর বাড়িটি ঘিরে উৎসুক জনতার ভিড়। থানা পুলিশ ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কর্মকর্তারা আলমত সংগ্রহ করছেন। মূল ফটকে প্রবেশ করতেই রক্তের দাগ চোখে পড়ল। লম্বা দাগ ধরে নিচতলার পেছনে গিয়েও ছোপ ছোপ রক্ত দেখা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, শফিকুর রহমানের মৃত্যু নিশ্চিত করতে হত্যাকারীরা টেনেহিঁচড়ে ওখানে নিয়ে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। এরপর দোতলার গিয়ে দেখা যায় একটি কক্ষ এলামেলো অবস্থায় রয়েছে, সেখানেও রক্তের দাগ। খুনিরা দোতলার এ কক্ষে ফরিদাকে হত্যার পর চারতলা ভবনের ছাদে গিয়ে পাশের নির্মাণাধীন ভবন বেয়ে পালিয়ে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পাশের ওই ভবনের সিঁড়িতে রক্তমাখা হাতের ছাপ রয়েছে।
এদিকে এমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা বাড়ির অন্য বাসিন্দারা টের পাননি বলে জানিয়েছেন। পারভেজ নামের এক প্রতিবেশী বলেন, শফিকুর প্রতিদিন ভোরে নামাজ পড়তে যান। ফেরার পথে হয়তো ওতপেতে থাকা খুনিরা তাকে হত্যা করেছে। পরে তার স্ত্রীকেও হত্যা করে তারা পালিয়ে গেছে। আশপাশের লোকজন নিচে লাশ দেখে ৯৯৯-এ ফোন করে পুলিশকে জানান।
পিবিআইয়ের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, চুরি বা ডাকাতির ঘটনায় এই হত্যাকাণ্ড হয়েছে-এমন প্রমাণ এখনো পাওয়া যায়নি। তাদের সঙ্গে স্থানীয় কারও বিরোধও ছিল না। আমরা জানতে পেরেছি তাদের গ্রামের বাড়ি ফেনীতে জমি নিয়ে শফিকুরের পারিবারিক ঝামেলা ছিল। এ ঘটনায় একাধিক মামলাও চলছিল। এই বিরোধের জেরে এ হত্যাকাণ্ড হতে পারে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করছি। এছাড়াও খুনিদের শনাক্ত করতে আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজসহ অন্যান্য আলামত পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিহত শফিকুর রহমানের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে ফেনির দাগনভূঞায় চাচাতো ভাইয়ের ছেলেদের সঙ্গে জমিসংক্রান্ত বিরোধ চলছিল। তার বিরুদ্ধে ওই জমির বিরোধের চারটি মামলা করেছে তারা। মামলাগুলোর মধ্যে দুটি খারিজ হয়ে গেছে। আর দুটি মামলার তদন্ত চলমান। এ বিষয়ে শফিকুর রহমানের আপন ভাই মফিজুর রহমান বলেন, যাদের সঙ্গে জমি নিয়ে বিরোধ তারা আমাদের শরিক ও ভাগীদার হলেও খুবই দুষ্ট প্রকৃতির। আমাদের চাচাতো ভাইয়ের এক ছেলে শফিকুর ভাইয়ের থেকে জোর করে কিছু জমি কিনতে চেয়েছে কয়েকবার। কিন্তু ভাই সেটা দেয়নি। এটা নিয়েই তারা একের পর এক মিথ্যা মামলা দিয়েছে।
এসআই ইমন বলেন, জন্ম থেকে এই এলাকায় বেড়ে উঠেছি। দীর্ঘ ২৮ বছরের জীবনে এখানে কারও সঙ্গে কোনো শত্রুতা ছিল না। আজকে বিষয়টি জানার পর থেকে এখন পর্যন্ত কোনো কূলকিনারা পাচ্ছি না, কেন এমন হলো। এ ধরনের ঘটনা অতিমাত্রায় শত্রুতা যদি থাকে সেই ক্ষেত্রে ঘটে থাকে। এমন শত্রুতা আমার এবং বাবার সঙ্গে নেই। এজন্য বুঝতে পারছি না কেন ঘটল। জমিজমাকেন্দ্রিক ঝামেলায় আমরা ছাড়াও আরও অনেকেই জড়িত। ওটা কেন্দ্রিক কিনা, সেটাও বুঝতে পারছি না।
যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবুল হাসান বলেন, তাদের পারিবারিক জমিসংক্রান্ত বিরোধকে আমরা তদন্তে প্রাধান্য দিচ্ছি। তবে এটা শতভাগ নিশ্চিত না হয়ে কিছু বলা যায় না। যাদের সন্দেহ করা হচ্ছে, তাদের একজন দেশের বাইরে থাকেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার মো. ইকবাল হোসাইন বলেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে তাদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় জমিসংক্রান্ত বিরোধসহ বিভিন্ন বিষয় সামনে রেখে আমাদের তদন্ত চলছে, তদন্ত শেষ হলে হত্যার প্রকৃত কারণ জানা যাবে।