বেইলি রোডে আগুনের তদন্ত প্রতিবেদন: তদারক সংস্থাগুলোর পদে পদে গাফিলতি
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৯ এপ্রিল ২০২৪, ০২:২৪ এএম
রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সেবা সংস্থাগুলোর পদে পদে গাফিলতির চিত্র উঠে এসেছে। ভবন নির্মাণ ও ব্যবহারে লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে সংস্থাগুলো অনুমোদিত নকশা যথাযথভাবে অনুসরণ করেনি। ভবন ব্যবহারের সনদ বা অকুপেন্সি সার্টিফিকেট গ্রহণ সংক্রান্ত নির্দেশনাও মানেননি সংশ্লিষ্টরা। তাদের দায়িত্বে অবহেলার কারণেই বেইলি রোডে ভয়াবহ এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। তদারক সংস্থাগুলোর পৃথক তদন্তে দায়িত্বে অবহেলার এমন চিত্র পাওয়া যায়।
২৯ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে লাগা আগুনে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় রাজধানীর রমনা থানায় একটি মামলা হয়। তখনই তদারক সংস্থাগুলোকে ‘ম্যানেজ’ করে ভবন ব্যবহারে নানা অনিয়মের কথা জানা গিয়েছিল। এ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি ২৭ মার্চ প্রতিবেদন জমা দেয়। তাছাড়া প্রতিবেদন দিয়েছে ফায়ার সার্ভিসের পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি এবং তিতাসের কমিটিও। তবে প্রতিটি সংস্থাই তাদের প্রতিবেদনে নিজেদের দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছে।
প্রতিবেদনের বিষয়ে রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী উজ্জ্বল মল্লিক যুগান্তরকে বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনে বেইলি রোডের ভবন নকশা অনুযায়ী নির্মিত হয়েছে এবং নির্মাণ ত্রুটি নেই, সেটা বলা হয়েছে। পাশাপাশি আবাসিক কাম বাণিজ্যিকের ব্যবহার নিয়ে রেস্টুরেন্ট গড়ে তোলা, ভবনের ব্যবহার অনুমোদনপত্র না নেওয়ার বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। এ বিষয়গুলো ভবন মালিক এবং অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তবে ভবন মালিক বা অন্য সংস্থার ব্যত্যয়ের ক্ষেত্রে রাজউকের দায়িত্ব ছিল তাদের নোটিশ করা। সেগুলো রাজউক করতে পারেনি। এ দায় রাজউক এড়াতে পারে না। এজন্য রাজউক অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছে। পাশাপাশি মনিটরিং কার্যক্রম জোরদার করতে থার্ড পার্টিকে দায়িত্ব দেওয়ারও চিন্তা করছে।
রাজউক তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, ইমারত বিধিমালা অনুযায়ী ভবন মালিক যদি অকুপেন্সি সার্টিফিকেট গ্রহণ নিশ্চিত করতেন, তাহলে এ ভয়াবহ দুর্ঘটনার আশঙ্কা কমে যেত। এছাড়া এই সার্টিফিকেট গ্রহণ করে পাঁচ বছর পরপর যদি লাইসেন্স নবায়ন করা যেত, তাহলে ভবন মালিক অনিয়ম করে ভবন অন্য কাজে ব্যবহারের সুযোগ পেতেন না।
তাছাড়া রেস্টুরেন্ট মালিকরা অত্যন্ত দাহ্য বস্তু ব্যবহার করে তাদের প্রতিষ্ঠানের ইন্টেরিয়র ডিজাইন করেছেন। যার ফলে আগুনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছিল। সিলিন্ডার ব্যবহারের ক্ষেত্রে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়নি এবং অগ্নিনির্বাপণের যথাযথ ব্যবস্থা রাখা হয়নি। অগ্নিনির্বাপণ বিধিমালা অনুযায়ী ভবনে নিয়মিত অগ্নি মহড়া করা হলে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেত এবং ফায়ার সেফটি প্রটোকল অনুসরণ করা যেত।
এ তদন্ত কমিটি প্রতিবেদনে ছয় দফা সুপারিশ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ভবন ব্যবহারের সনদ ছাড়া যেন গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ ইত্যাদি সেবা সরবরাহ করা না হয়। যারা ভবন নির্মাণের নকশা করেন, তারা যেন নির্মাণকাজ শেষ হলে সমাপ্তি প্রতিবেদন পেশ করেন এবং তাতে নির্মাণে অনিয়মসহ অন্যান্য বিষয়াদি উল্লেখ করেন। প্রাকৃতিক গ্যাস ও এলপি গ্যাস সরবরাহকারী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ সংক্রান্ত নিরাপত্তার বিষয়গুলো নিয়মিত পরিদর্শন ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিশ্চিত করা। ৫ তলা বা তদূর্ধ্ব আবাসিক কাম বাণিজ্যিক বা শিল্পকারখানা বা বাণিজ্যিক ভবনগুলোয় কমপক্ষে ৩-৬ মাস পরপর অগ্নি মহড়া পরিচালনা বাধ্যতামূলক করা। ফায়ার লাইসেন্স প্রদান ও নবায়নের ক্ষেত্রে রাজউকের ব্যবহার সনদ বাধ্যতামূলক করা।
এদিকে ফায়ার সার্ভিসের তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বাণিজ্যিক কার্যক্রমের জন্য রাজউক ভবনের নকশা অনুমোদন করলেও এতে রেস্টুরেন্ট ব্যবসার অনুমতি ছিল না। কিন্তু ভবনের বেজমেন্ট (গাড়ি পার্কিংয়ের স্থান) ছাড়া সবকটি তলায় ছিল রেস্টুরেন্ট। এতে ভবনে যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, সে অনুযায়ী কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ভবনের অগ্নিনিরাপত্তার পরিকল্পনা অনুমোদন করা হয়নি। পুরো ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরে (তলা), সিঁড়িতে একের পর এক গ্যাস সিলিন্ডার রাখা হয়েছিল। ভবনে সিঁড়িও ছিল মাত্র একটি। এমনকি বিভিন্ন রেস্টুরেন্টের ক্যাশ কাউন্টারের পাশেও রাখা ছিল গ্যাস সিলিন্ডার। ভবনের নিচতলার ‘চুমুক’ নামের চা-কফির দোকানের ইলেকট্রিক চুলায় বৈদ্যুতিক গোলযোগ (শর্ট সার্কিট) থেকে আগুনের সূত্রপাত। সেখানে গ্যাস সিলিন্ডারের লাইনের ছিদ্র থেকে বের হওয়া গ্যাসের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া ভবনে জরুরি বহির্গমন সিঁড়ি না থাকায় মানুষ চেষ্টা করেও বের হতে পারেনি।