আবাসিক হলে গোপন টর্চার সেল, জাবিতে মাদক সিন্ডিকেটেও ছাত্রলীগের বাহিনী
ইকবাল হাসান ফরিদ ও মোসাদ্দেকুর রহমান
প্রকাশ: ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:৩৭ এএম
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) শাখা ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের একটা অংশ গুরুতর অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। এমনকি মাদক সিন্ডিকেটের সঙ্গেও জড়িয়েছে তারা। এই সিন্ডিকেটের সদস্যরা ক্যাম্পাস ও আশপাশ এলাকা দাবড়িয়ে বেড়াচ্ছে। তাদের অপরাধের সবশেষ শিকার স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে গণধর্ষণ। মীর মশাররফ হোসেন হলে স্বামীকে আটকে রেখে তার স্ত্রীকে জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণের ঘটনার নেপথ্যেও মাদক সিন্ডিকেটের হাত রয়েছে। যুগান্তরের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন তথ্য।
এদিকে মাদক সিন্ডিকেটে জড়িত ছাত্রলীগের বেপরোয়া বাহিনী হলে হলে গড়ে তুলেছে টর্চার সেল। শিক্ষার্থী নির্যাতন এবং চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন ঘটনায় টার্গেট ব্যক্তিকে তুলে এনে এসব সেলে নির্যাতনের ঘটনা অহরহ ঘটছে। তবে ভুক্তভোগীরা ভয়ে মুখ না খোলায় বেশিরভাগ ঘটনাই থেকে যায় আড়ালে। শিক্ষার্থীরা বলছেন, ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের বেপরোয়া আচরণে অনিরাপদ হয়ে উঠেছে জাবি ক্যাম্পাস।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের বেপরোয়া অংশের একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ কেন্দ্রীয় কমিটিও। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভেঙে দেওয়া হতে পারে জাবি ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ ইনান যুগান্তরকে বলেন, জাবি ছাত্রলীগের গতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে আমরা অতি দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেব। আমরা কোনো ধরনের অনিয়ম-অপরাধকে প্রশ্রয় দেই না। যারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত তাদের অপরাধী হিসাবে দেখি।
এদিকে গৃহবধূ ধর্ষণের ঘটনার বিচার দাবিতে বুধবারও উত্তাল ছিল জাবি ক্যাম্পাস। এদিন বিভিন্ন সংগঠন এবং যৌন নিপীড়নবিরোধী মঞ্চের উদ্যোগে পৃথক মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। এসব কর্মসূচি থেকে জাবি ক্যাম্পাসে মাদকের অবাধ ব্যবহার রোধ এবং অছাত্রদের হল থেকে বের করার দাবি জানানো হচ্ছে।
জাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মোতাহার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ‘কিছু কুলাঙ্গার আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি বিশ্বপরিমণ্ডলে পদদলিত করেছে। আমরা এর থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। পৈশাচিক এ ঘটনাকে বিছিন্ন ঘটনা বলে মনে করার সুযোগ নেই। এর আগেও দেখেছি, গ্রেফতার হলেও শেষ পর্যন্ত দোষীরা বেরিয়ে আসে। সরকারের কাছে আমি দাবি জানাই, এদের যেন প্রকৃত বিচারটা হয়।’
জাবি সিনেট সদস্য অধ্যাপক শামছুল আলম বলেন, সংগঠনের নাম ভাঙিয়ে যারা অপকর্ম করে তাদের বিতাড়িত হতে হবে। ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক গোলাম রব্বানী বলেন, এ ক্যাম্পাস ধর্ষক, চাঁদাবাজ, মাদক ব্যবসায়ী মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব।
এদিকে গৃহবধূ ধর্ষণের ঘটনায় ছাত্রলীগ নেতা মোস্তাফিজুর রহমানসহ ৪ জনের ৩ দিনের রিমান্ড বুধবার শেষ হয়েছে। আজ (বৃহস্পতিবার) তাদের আদালতে হাজির করা হবে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, রিমান্ডে মোস্তাফিজুর রহমান তার সহযোগী মাদক ব্যবসায়ী মামুনকে দিয়ে পরিকল্পিতভাবে ওই গৃহবধূ ও তার স্বামীকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ডেকে আনে। এরপর স্বামীকে হলে আটকে রেখে গৃহবধূকে জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণের কথা স্বীকার করেছে। মোস্তাফিজ নিজে মাদক সেবন করে এবং মাদক ব্যবসায় জড়িত বলে রিমান্ডে স্বীকার করেছে। ঘটনার অন্যতম মাস্টারমাইন্ড বহিরাগত মামুনুর রশিদ মামুন সম্পর্কে মোস্তাফিজুর রহমানের কাছ থেকে আরও গুরুত্বপূর্ণ বেশকিছু তথ্য পেয়েছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই চলছে বলে জানান একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা। তিনি আরও জানান, মামলায় অপর দুই আসামি মামুন ও মুরাদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারিতে রয়েছে। ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ হিল কাফী যুগান্তরকে বলেন, পলাতক আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। যে কোনো সময় তাদের গ্রেফতার দেখানো হবে।
সংশ্লিষ্ট অপর একটি সূত্র জানিয়েছে, জাবি ধর্ষণকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড মামুন দীর্ঘদিন ধরে ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে আসছে। টেকনাফ ও কক্সবাজার থেকে ইয়াবা এনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মাদকসেবীদের কাছে সরবরাহ করত। মামুনের বিরুদ্ধে বগুড়া সদর থানা, চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থানা এবং ডিএমপির মিরপুর থানায় পৃথক তিনটি মাদকের মামলা রয়েছে।
সূত্র জানায়, জাবি ছাত্রলীগের একটা অংশ দুর্বৃত্তায়নে জড়িয়ে পড়েছে। কয়েকজন নেতার শেল্টারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস মাদক সেবনের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন পয়েন্টে দিন-দুপুরে চলে মাদক সেবন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীসহ বহিরাগতরা এসব মাদকের আসর জমায়। তাছাড়া আবাসিক হলগুলো হয়ে উঠেছে মাদক সেবনের নিরাপদ আশ্রয়স্থল। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাবেক কয়েকজন নেতা পার্শ্ববর্তী আমবাগান, গেরুয়া ও ইসলামনগর এলাকা থেকে তাদের অনুসারী বর্তমান কমিটির কতিপয় নেতার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদক সরবরাহ করে।
একাধিক শিক্ষার্থী যুগান্তরকে জানিয়েছেন, সন্ধ্যার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠ, কেন্দ্রীয় খেলার মাঠ, বঙ্গবন্ধু হলের মাঠ, টিএসসির ছাদ, বটতলার পেছনের এলাকা, জাকসু ভবন, পরিবহন চত্বর, বিশমাইল বাস ডিপোসহ বিভিন্ন পয়েন্টে বসে ইয়াবা, গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদক সেবনের আসর।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দাবি, ক্যাম্পাসে মাদক নির্মূলে নিয়মিত অভিযান চালানো হয়। হলগুলোতে মাদক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব হল প্রশাসনের জানিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান যুগান্তরকে বলেন, বহিরাগতরা শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদক সেবন করে। এ ব্যাপারে হল প্রশাসনকে আরও তৎপর হতে হবে। আমাদের কাজের পরিধি আরও বাড়াতে হবে।
হলে হলে টর্চার সেল : মীর মশাররফ হোসেন হলের ৩১৭ নম্বর কক্ষটি টর্চার সেল হিসাবে ব্যবহার করত ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতারা। এর আগেও পৃথক দুটি ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে শহিদ সালাম-বরকত হল ও মওলানা ভাসানী হলে টর্চার সেলের সন্ধান পাওয়া যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য হলগুলোতেও ছাত্রলীগের আরও কয়েকটি টর্চার সেল আছে বলে একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র যুগান্তরকে নিশ্চিত করেছে। স্বামীকে আটকে রেখে গৃহবধূকে জঙ্গলে নিয়ে ধর্ষণের ঘটনার পর মীর মশাররফ হোসেন হলের ‘টর্চার সেল’ খ্যাত ৩১৭ নম্বর কক্ষে মারধর ও মাদক সেবনের বিভিন্ন আলামত পাওয়া গেছে। এর আগেও ওই কক্ষে আশুলিয়া থানার একজন পুলিশ কনস্টেবলকে আটকে রেখে ৫০ লাখ টাকা দাবি করে অভিযুক্তরা। আশুলিয়া থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ঘটনাটি সমঝোতা করেন বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জানান, হলের ৩১৭ নম্বর কক্ষটিকে অভিযুক্তরা টর্চার সেল হিসাবে ব্যবহার করত এবং ওই কক্ষে তারা নিয়মিত ইয়াবা সেবন করত। এছাড়াও সিএন্ডবি, ডেইরি গেট ও হলের সামনের দোকানগুলো থেকে তারা নিয়মিত চাঁদা আদায় করত। কেউ চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে তাকে ধরে এনে ওই কক্ষে শায়েস্তা করা হতো।
অন্যদিকে গত বছরের ৮ ফেব্র“য়ারি শহিদ সালাম-বরকত হলের টর্চার সেল খ্যাত ২১৪ নম্বর কক্ষে বহিরাগত এক যুবককে ধরে এনে ১০ লাখ টাকা চাঁদার দাবিতে নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনে অচেতন হয়ে পড়া ওই ভুক্তভোগীর কাছ থেকে নগদ ৪০ হাজার ও বিকাশে ৫ হাজার টাকা আদায়ের অভিযোগ উঠে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক অসিত পালের বিরুদ্ধে। পরে রাতে সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে হল প্রশাসন অভিযান চালিয়ে ওই কক্ষ থেকে একটি লোহার পাইপ, চাকু, বিভিন্ন ইনজেকশন ও মাদকদ্রব্য উদ্ধার করে।
ছাত্রলীগের আরমান খান যুবর বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানী হলের ১২৬ নম্বর কক্ষকে ‘টর্চার সেল’ হিসাবে ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে মাদকের সিন্ডিকেট পরিচালনা করার অভিযোগ রয়েছে। তার ছাত্রত্ব শেষ হলেও হলের ওই কক্ষে তিনি অবৈধভাবে অবস্থান করে অপরাধ করছে। গত বছরের ১০ সেপ্টেম্বর বহিরাগত এক যুবককে ১২৬ নম্বর কক্ষে এনে মারধর করেন যুব। এসব অভিযোগের বিষয়ে ব্যাপারে আরমান খান যুবর ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি ফোনকল রিসিভ করেননি।
এ বিষয়ে জাবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান লিটন যুগান্তরকে বলেন, একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আবাসিক হলে ‘টর্চার সেল’ থাকলে তা অবশ্যই দুঃখজনক। একজন শিক্ষার্থী এখানে পড়াশোনা করতে আসে। ‘টর্চার সেল’র নামে নিপীড়নের শিকার হতে আসে না।
শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি আক্তারুজ্জামান সোহেল বলেন, ছাত্রলীগের কোনো নেতাকর্মী যদি ‘টর্চার সেল’ পরিচালনা করে বা এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
শনিবার রাত সাড়ে ৯টায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলের ৩১৭ নম্বর কক্ষে স্বামীকে আটকে রেখে কৌশলে স্ত্রীকে হলসংলগ্ন জঙ্গলে নিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করেন আসামি মোস্তাফিজুর রহমান ও মামুনুর রশীদ মামুন। এ ঘটনায় মোস্তাফিজসহ তিনজনকে পরদিন সকালে গ্রেফতার করে সাভার থানা পুলিশ। এ ব্যাপারে ভুক্তভোগীর স্বামী বাদী হয়ে আশুলিয়া থানায় মামলা করেন।