
প্রিন্ট: ২১ এপ্রিল ২০২৫, ০২:২৩ পিএম
নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতাকে ছাত্রদল নেতার ‘আশ্রয়’ নিয়ে রাবিতে তিন দফায় সংঘর্ষ

রাবি প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৫ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৪৭ পিএম

আরও পড়ুন
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্বের ঘটনার জের ধরে দুইপক্ষের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ ও মারধরের ঘটনা ঘটেছে। এতে উভয়পক্ষের অন্তত ৪ জন শিক্ষার্থী আহত হয়েছেন। মঙ্গলবার দুপুর ১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের টুকিটাকি চত্বরে, বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা কেন্দ্রে ও চিকিৎসা নিয়ে ফেরার পথে অ্যাম্বুলেন্সে এসব ঘটনা ঘটে।
ঘটনার সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ ও ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থীরা জড়িত থাকলেও অধিকাংশের রয়েছে রাজনৈতিক পরিচয়। কেউ ছাত্রদলের নেতাকর্মী। আবার কেউ নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সাবেক নেতাকর্মী।
তবে অভিযোগ উঠেছে, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের এক নেতার ‘আশ্রয়কে’ কেন্দ্র করে সংঘর্ষের সূচনা করেছে ছাত্রদলের কয়েকজন নেতাকর্মী ও আইন বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
‘আশ্রয়’ পাওয়া ওই ছাত্রলীগ নেতা হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হবিবুর রহমান হলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সাধন মুখার্জি এবং তাকে ‘আশ্রয়’ দিয়েছেন রাজশাহী মহানগর শাখা ছাত্রদলের সাবেক সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক ও আইন বিভাগের শিক্ষার্থী শাহরুখ মাহমুদ।
এ ঘটনায় আহত শিক্ষার্থীরা হলেন- ফিন্যান্স বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের আসিফুর রহমান ও শাহাদাত হোসেন এবং আইন বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের মুহাইমিনুল ইসলাম নুহান ও ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী শাহরুখ মাহমুদ। আসিফুর রহমান বিশ্ববিদ্যালয় শাখা জাতীয়তাবাদী সামাজিক সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) কার্যনির্বাহী সদস্য, নুহান সাবেক ছাত্রলীগ কর্মী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঘটনার সূত্রপাত সাধন মুখার্জি নামের এক ছাত্রলীগ নেতাকে কেন্দ্র করে। সাধন আইন বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ও নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের শহীদ হবিবুর রহমান হল শাখার সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক। আইন বিভাগের শিক্ষার্থীদের দাবি, গত বছরের রমজান মাসে সাধন মুখার্জির এক জুনিয়রকে ইভটিজিং করেন ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থী শাহাদাত হোসেন। এ সময় দুইপক্ষের মধ্যে বাগবিতণ্ডা হয়।
তবে অন্যপক্ষের দাবি, গতবছর ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থীরা ইফতার মাহফিলের আয়োজন করে। ইফতার শেষে ফেরার পথে বিভাগের শিক্ষার্থী ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কাইয়ুম মিয়া তাদের পথ রোধ করে দাঁড়ায়। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রশ্নে এক পর্যায়ে আয়োজনকারী শাহাদাত হোসেনসহ ১০-১২ জনকে কাইয়ুম, সাধন ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের মারধর করেন।
গত বছরের জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান চলাকালে ক্যাম্পাস ছাড়েন ছাত্রলীগ নেতা সাধন মুখার্জি। পরে ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আর ক্যাম্পাসে ফেরেননি তিনি। তবে মাস্টার্সের পরীক্ষায় অংশ নিতে গত কিছুদিন আগে আবার ক্যাম্পাসে ফেরেন সাধন মুখার্জি। তার বন্ধু ছাত্রদল নেতা শাহরুখ মাহমুদের আশ্রয়ে ক্যাম্পাসে চলেন তিনি।
পরবর্তীতে গতবছরের ঘটনার জেরে গত সোমবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন কাজলায় একটি বাস কাউন্টারে সাধন মুখার্জিকে মারধর করেন শাহাদাৎ ও আসিফুরসহ ফিন্যান্স বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী। পরে সাধন মুখার্জির পক্ষ নিয়ে আসিফুর রহমানের ছাত্রাবাসে যায় আইন বিভাগের শিক্ষার্থী এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের সদস্য আকিল বিন তালেব, ছাত্রদল নেতা শাহরুখ মাহমুদসহ আইন বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী। তবে তাকে ছাত্রাবাসে না পেয়ে ফিরে আসে তারা।
এ ঘটনার জের ধরে আজ মঙ্গলবার বেলা ১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের টুকিটাকি চত্বরে শাহাদাতকে মারধর করেন ছাত্রদল নেতা শাহরুখ, আইন বিভাগের শিক্ষার্থী আমির (ছাত্রদল কর্মী), রফিক (ছাত্রদল কর্মী), নুহানসহ (সাবেক ছাত্রলীগ কর্মী) অন্তত ১০ জন শিক্ষার্থী। একপর্যায়ে শাহাদাতকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন তার বন্ধু আসিফুর রহমান। এ সময় তাকেও মারধর করেন আইন বিভাগের শিক্ষার্থীরা। পরে তাদের সঙ্গে যোগ দেন ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থীরা। এতে দুইপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বেধে যায়। সংঘর্ষে আহত হন শাহাদাত, আসিফুর ও নুহান। এ ঘটনায় আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার জন্য দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা কেন্দ্রে নেওয়া হয়।
পরে দুপুর ২টার দিকে দলবল নিয়ে চিকিৎসা কেন্দ্রে যান ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থীরা। সেখানে গিয়ে তারা নুহানের সঙ্গে থাকা শাহরুখ মাহমুদকে বেধড়ক মারধর করেন। একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মাহবুবর রহমান ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি শান্ত করেন। পরে নুহান ও শাহরুখকে উন্নত চিকিৎসার জন্য রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। পরবর্তীতে আরেকটি অ্যাম্বুলেন্সে হাসপাতালে পাঠানো হয় শাহাদাত ও আসিফুরকে। বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে হাসপাতাল থেকে ফেরার পথে অ্যাম্বুলেন্স থামিয়ে আইন বিভাগের শিক্ষার্থী আমিরের নেতৃত্বে কয়েকজন তাদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় অ্যাম্বুলেন্স চালককেও মারধর করেন তারা।
এ ঘটনার পর আইন বিভাগের শিক্ষার্থী আমিরের ছাত্রত্ব বাতিলসহ কয়েক দফা দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান করেন ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থীরা।
ঘটনার বিষয়ে শাহাদাত হোসেন বলেন, গত বছর রমজানে ইফতার মাহফিল করতে গিয়ে সাধন আমাদের বাধা দিয়েছিল। সোমবার তাকে ক্যাম্পাসে দেখতে পেয়ে আমরা তার সঙ্গে সেই ঘটনার বিষয়ে কথা বলি। একপর্যায়ে আমাদের মধ্যে হাতাহাতি হয়। আজকে সাধনের পক্ষ নিয়ে ছাত্রদলের কয়েকজন ছেলে আমাদের ওপর হামলা চালায়।
মারধরের শিকার আরেক শিক্ষার্থী আসিফুর রহমান বলেন, স্বৈরাচারের দোসরকে বাঁচাতে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা আমাদের ওপর টুকিটাকিতে হামলা করেছে। এর আগে সোমবার রাতেও সমন্বয়ক আকিল বিন তালেব ও ছাত্রদল নেতাকর্মী আমার বাসার সামনে গিয়ে বিশৃঙ্খলা করে। এরপর আজ মঙ্গলবার আমরা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গেলে সেখানেও আমাদের অ্যাম্বুলেন্সে তারা হামলা চালায়। আমরা এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই।
আহত ছাত্রদল নেতা শাহরুখ মাহমুদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলে তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
সাবেক সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের সদস্য আকিল বিন তালেব বলেন, গতকাল রাতে আমি ঘটনার তেমন কিছু জানতাম না। বিভাগের বড় ভাইয়ের সঙ্গে ঝামেলা হওয়ায় আমি উপস্থিত হয়েছিলাম।
এ বিষয়ে নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের হবিবুর রহমান হল শাখার সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সাধন মুখার্জি বলেন, ২০২৪ সালে এক নারী শিক্ষার্থীকে ইভটিজিংয়ের জন্য ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ঝামেলা হয়। পরে আমি পরীক্ষা দিতে ক্যাম্পাসে গেলে আমার ওপর সোমবার হামলা করা হয়েছে। পরে আমি বাড়িতে চলে এসেছি। পরবর্তী ঘটনার সঙ্গে আমার সংশ্লিষ্টতা নেই।
এ বিষয়ে আইন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক সাঈদা আঞ্জু ও ফিন্যান্স বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক শিবলি সাদিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
ঘটনার সঙ্গে ছাত্রদল নেতার সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের আহ্বায়ক সুলতান আহমেদ রাহী বলেন, যতদূর জানতে পেরেছি এ ঘটনায় ছাত্রদলের যারা জড়িত তারা ব্যক্তিগত কারণে গিয়েছে। তবে ছাত্রদলের কেউ আইন নিজ হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনায় যুক্ত থাকলে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক মাহবুবর রহমান বলেন, এ ঘটনার সব ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করা হচ্ছে। সেই ফুটেজ বিশ্লেষণ করে অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে জড়িত সব অপরাধীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।