বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের বলি শিক্ষার্থীরা

কুবি প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৭:২৮ পিএম
-67c1ba000bfec.jpg)
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়কে (কুবি) আয় দেখাতে বলেছে ৫ কোটি ৬০ লাখ টাকা। সেই আয়ের ভার টানতে হচ্ছে কুবির ভর্তিচ্ছু ও অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির রসিদ অনুযায়ী ভর্তি ফি, সেমিস্টার, বেতন, আবাসিক হল, গ্রন্থাগার, ছাত্র-ছাত্রী কল্যাণ, বিএনসিসি ও রোভার স্কাউট ফি-সহ আয়ের খাত দেখানো হয়েছে ১৫টি। বিগত বছরগুলোতে এসব খাতে শিক্ষার্থীদের গুনতে হতো ১৭ হাজার ৭০০ টাকা। এছাড়া সেমিস্টার বাবদ ৫৫০ টাকা থেকে ৪৫০০ টাকা পর্যন্ত ফি।
সর্বশেষ ২০১৯-২০ সেশনে নিজস্ব পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষায় আবেদন ফি ৫৫০ টাকা থাকলেও পাঁচ বছর পর ২০২৪-২৫ সেশনে তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ১ হাজার টাকা। এছাড়াও বর্তমানে অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীদের সেমিস্টার ফিও বাড়িয়ে করা হয়েছে ১ হাজার টাকা।
এদিকে গত ১৭ অক্টোবর রেজিস্ট্রার মুজিবুর রহমান স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, স্নাতক প্রথম বর্ষে ফি ১ হাজার, ২য় বর্ষে ৫৫০ টাকা ফি বৃদ্ধি করা হয়েছে। অন্যদিকে স্নাতকোত্তরের (বিজ্ঞান, সমাজ বিজ্ঞান, প্রকৌশল, ব্যবসা ও আইন) অনুষদের ভর্তির ফি আগে ৭ হাজার ৮শ থাকলেও ২০২৩-২৪ সেশনে সেই ভর্তি ফি ৮ হাজার ৯শত টাকা হয়েছে। ১০০ টাকার হল ফি বৃদ্ধি করে ১৫০ টাকা হয়েছে। এছাড়াও স্নাতকের নতুন শিক্ষার্থীদের ভর্তির ক্ষেত্রেও বাড়ানো হয়েছে প্রায় ২ হাজার টাকা।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা না করেই ইউজিসির স্বার্থে বেতন-ফি বৃদ্ধি করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য আয়ের খাতগুলো উপেক্ষিত করে শিক্ষার্থীদের বলি দিচ্ছে প্রশাসন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিবৃত্তিক সংগঠন পাটাতনের সাধারণ সম্পাদক সায়েম মোহাইমিন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। এখানে সরকার প্রতিবছর ভর্তুকি দিয়ে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। এ ধরণের প্রতিষ্ঠানে ফি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ শিক্ষার্থীদের দিকে নজর রাখা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যয় বাড়লে সেক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ওপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি কখনোই সমাধান হতে পারে না।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশনের কাছ থেকে দান অনুদান সংগ্রহ করতে পারে। যেমনটা আমরা অক্সফোর্ড, কেমব্রিজের মতো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেখতে পাই। শিক্ষার মতো সেবা খাতে বিকল্প অর্থসংস্থানের ব্যবস্থা করাও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নৈতিক দায়িত্ব।
বিশ্ববিদ্যালয় অর্থ দপ্তরের সূত্র জানায়, ইউজিসির যে আয় ধরে দেওয়া হয় কর্তৃপক্ষ দিতে না পারলে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে বাজেট রয়েছে তা থেকে কেটে রাখা হয়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন সংকুচিত হয়ে যায়।
তবে অর্থ দপ্তরের সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন বলেন, ইউজিসি আমাদের সকল আয়-ব্যয় চেক করে দেখার পর যদি দেখতে পায় আয়ের কোনো সুযোগ নাই তখন অর্থ কেটে রাখার প্রশ্নই আসে না।
সাবেক রেজিস্ট্রার আমিরুল হক চৌধুরীর কাছে কততম সিন্ডিকেট সভায় ফি বৃদ্ধির বিষয়টি পাস হয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা আমার মনে নেই। তবে অর্থ বিষয়ক কোনো কিছু সিন্ডিকেটে যাওয়ার আগে অর্থ কমিটির অনুমোদন লাগে। তৎকালীন অর্থ কমিটি এটার অনুমোদন দিয়েছিল।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সোলায়মান বলেন, নতুন প্রশাসন শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কোন নিয়ম করে নাই। শিক্ষার্থীদের ভর্তি ফি, হল ফি বৃদ্ধি আগের প্রশাসনের। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮৫তম সিন্ডিকেট সভায় তারা এগুলো পাশ করিয়ে নেয়।
ফি কমানো হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা যেহেতু সিন্ডিকেট সভায় পাশ করে আসছে সেজন্য এখন বলা যাচ্ছে না। আমরা এটা নিয়ে আলোচনা করবো।
তবে ইউজিসির অর্থ কেটে রাখার বিষয়ে জানা নেই বলে জানান কোষাধ্যক্ষ।
উপাচার্য অধ্যাপক ড. হায়দার আলী বলেন, আমি আসার আগেই শিক্ষার্থীদের ফি বৃদ্ধি করা হয়েছে। আমি আসার পর ফি বৃদ্ধি নিয়ে শিক্ষার্থীরা আমার কাছে এসেছিল।
ফি কমানো হবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ফি কমানো কষ্টকর। ইউজিসি বারবার তাগিদ দিচ্ছে নিজেদের কিছু আয় করার জন্য কিন্তু প্রান্তিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের ফি ছাড়া আয়ের খাত নাই বললেই চলে। তবুও শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে বিষয়টি আমি সিন্ডিকেট সভায় তুলবো।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ কেটে রাখার বিষয়ে জানতে চাইলে ইউজিসির অর্থ, হিসাব ও বাজেট বিভাগের পরিচালক মো. রেজাউল করিম হাওলাদার যুগান্তরকে বলেন, এমন কোনো নিয়ম নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের খাত না থাকলে আয় দেখাবে কোথায় থেকে?
ইউজিসির সদস্য প্রফেসর মোহাম্মদ তানজীমউদ্দিন খান বলেন, এটা ইউজিসির বিষয় না। অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিষয়, তারা ভালো বলতে পারবে।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ২০০৬-২৬ সাল পর্যন্ত যে উচ্চশিক্ষার চার স্তরবিশিষ্ট কৌশলপত্র লেখা হয়। এতে প্রথম পর্যায় শুরু হয়েছে ২০০৬-০৭ সালে। স্বল্পমেয়াদি পর্যায় ছিল ২০০৮-১৩। মধ্যমেয়াদি পর্ব মাত্র শুরু হয়েছে ২০১৪-১৯ এবং দীর্ঘমেয়াদি পর্ব নির্ধারিত ২০২০-২৬। প্রতিটি স্তরে ২৫ শতাংশ হারে শিক্ষা ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে এবং ২০২৬ সাল নাগাদ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অন্তত ৫০ শতাংশ ব্যয় অভ্যন্তরীণ খাত থেকে জোগাড় করার কথা বলা হয়েছে।