‘রক্তাক্ত কুয়েট’ প্রদর্শনী
রাতে উপাচার্যের বাসভবনে তালা দিল শিক্ষার্থীরা
সহিংসতার নেপথ্যে লাভ-লসের নানা সমীকরণ

খুলনা ব্যুরো
প্রকাশ: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) উপাচার্যের বাসভবনে তালা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। শুক্রবার রাত ৮টার দিকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা মিছিল সহকারে গিয়ে গেটে তালা ঝুলিয়ে দেন। এর আগে ‘রক্তাক্ত কুয়েট’ শিরোনামে ১৮ ফেব্রুয়ারির হামলার ছবি প্রদর্শনী করেন শিক্ষার্থীরা। শুক্রবার সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কল্যাণ ওয়েলফেয়ার সেন্টারে এই প্রদর্শনী শুরু হয়। এদিকে কুয়েটে সহিংসতা ঘিরে দেশব্যাপী নানা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। ছাত্রদলের সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে ঘটে যাওয়া এই সহিংসতার পেছনে কয়েকটি পক্ষের লাভ-লসের সমীকরণও সামনে এসেছে।
শিক্ষার্থীরা জানান, ‘রক্তাক্ত কুয়েট’ প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর যে নানা ট্যাগ লাগানোর অপচেষ্টা চালানো হচ্ছে, এর অবসান হবে। সেই সঙ্গে প্রকৃত অর্থে হামলাকারী কারা, সেটিও চিহ্নিত করা সহজ হবে। রক্তাক্ত কুয়েটের ওই ছবি থেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্ত সহজ হবে বলেও তারা মনে করেন।
তারা বলেন, এ প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে দেশবাসীর কাছে হামলার বিবরণ তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির যে কুফল, সেটিও তুলে ধরা হচ্ছে। প্রদর্শনীর বিভিন্ন ছবিতে আহত শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি যারা হামলা করেছে, তাদের ছবিও দেখা যাচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে কর্তৃপক্ষ সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করতে পারবে বলেও শিক্ষার্থীদের বিশ্বাস।
শিক্ষার্থীরা আরও বলেন, আমাদের বিরুদ্ধে অনেক প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে। অনেকে দায় এড়ানোর চেষ্টা করছেন। আমরা দেখাতে চাচ্ছি কারা হামলাকারী। সুতরাং যারা হামলাকারী, তাদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা হোক। এদিকে রাত ৮টার দিকে সাধারণ শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে গিয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাছুদের বাসভবনে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন। এ সময় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বলেন, আমরা নাকি মাসুদ স্যারকে নির্যাতন করেছি। এটি বলে যে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। আমরা যথেষ্ট সম্মানের সঙ্গে আচরণ করেছি তার শরীরে একটি টোকা দিয়েছি-এমন কোনো প্রমাণ বা ভিডিও কেউ দেখাতে পারবে না। তাছাড়া যে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, সেই কমিটিতে সাধারণ ছাত্রদের কাউকে রাখা হয়নি। এ কমিটির প্রতি আমাদের কোনো আস্থা নেই। ছাত্রদল ও বিএনপির সন্ত্রাসীরা যে নৃশংস হামলা চালিয়েছে, এর ভিডিও ফুটেজ ও ছবি থাকার পরও প্রশাসন নির্বিকার। এটা সাধারণ ছাত্রদের প্রতি তামাশা ছাড়া কিছুই নয়। এর মাধ্যমে তারা আমাদের আন্দোলন থেকে দূরে রাখার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
নেপথ্যে লাভ-লসের নানা সমীকরণ: জানা যায়, ফ্যাসিবাদ আমলে কুয়েট পরিচালিত হতো আওয়ামী লীগের ইশারায়। ৫ আগস্ট সরকারের পতনের পর বিশ্ববিদ্যালয়টির অষ্টম উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ পান মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মাছুদ। তিনি সেসময় আমেরিকায় ছিলেন। সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মিহির রঞ্জন পদত্যাগের সময় ড. মাছুদকে দায়িত্ব দিয়ে যান। বিষয়টি নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্যসহ বেশ কয়েকজন সিনিয়র শিক্ষকের মধ্যে ক্ষোভ ছিল। এরই মধ্যে নতুন উপাচার্য মাছুদ দৈনিক মজুরি ভিত্তিতে ৪২ জনকে নিয়োগ দেন, যা নিয়ে কর্মচারীদের একটি অংশও ব্যাপক ক্ষোভ প্রকাশ করেন। অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো দুটি ভবন ভেঙে বিক্রির জন্য ৩৫ লাখ টাকার দরপত্র নির্ধারণ করা হয়। সেই কাজ মাত্র ২৪ লাখ টাকায় সম্পন্ন করা হয়, যা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর ও বাইরে একটি অংশ ক্ষুব্ধ ছিল।
অন্যদিকে নতুন উপাচার্য যোগদানের পর সিন্ডিকেট সভায় উপ-উপাচার্যের ক্ষমতা হ্রাস করেছেন। একই সঙ্গে আর্থিক ব্যয় প্রক্রিয়া থেকে উপ-উপাচার্যকে কৌশলে সরিয়ে রাখতে চাচ্ছেন। এসব কারণে উপাচার্য ও উপ-উপাচার্যের মধ্যে দ্বন্দ্ব প্রবল হয়েছে। শিক্ষার্থীদের একটি অংশ দাবি করেছেন, উপাচার্য স্থানীয় বিএনপির নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন পরিচালিত করছেন। তবে বিএনপির ঊর্ধ্বতন অনেক নেতারই বিরাগভাজন তিনি। ফলে এ আন্দোলনে তাকে বিতর্কিত করতে অনেকেই ভূমিকা রেখেছেন কি না, তা নিয়েও চলছে আলোচনা। এছাড়া নতুন উপাচার্য যোগদানের পর ফ্যাসিবাদের সঙ্গে সরাসরি জড়িত-এমন শিক্ষক-কর্মচারীদের বরখাস্ত করেছেন, যা দেশের অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়নি। এ কার্যক্রমে প্রশংসাও কুড়িয়েছেন উপাচার্য।
এ বিষয়ে কুয়েট উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ মাছুদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রকল্যাণ পরিদপ্তরের পরিচালক ঠিকমতো রোলপ্লে করছেন না। আমরা এটা অবশ্যই দেখব। আমরা শিক্ষার্থীদের দাবি অনুযায়ী সবকিছু করছি।