৬ মাস অফিস না করেও চাকরিতে বহাল কুবি ছাত্রলীগের সম্পাদক

কুবি প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:১৩ পিএম

আওয়ামী ফ্যাসিজমের বিদায় এবং সরকারের পট পরিবর্তনের পর বিগত সরকারের আমলে নিয়োগ পাওয়া অনেক সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারি নিরুদ্দেশ হয়েছেন। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়েও একইভাবে নিরুদ্দেশ আছেন কুবি শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও হত্যা মামলার আসামি রেজিস্ট্রার দপ্তরের সেকশন অফিসার রেজাউল ইসলাম মাজেদ।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের আগে সর্বশেষ গত বছরের ১৬ জুলাই তিনি অফিস করেছিলেন। এরপর ৬ মাসের বেশি অতিক্রান্ত হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে আর দেখা যায়নি তাকে। এ অবস্থায় অনুমতি ছাড়া চাকরিতে অনুপস্থিত থাকা কিংবা চাকরি থেকে পলায়নের দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে সরকারি বিধি মোতাবেক চাকরি থেকে অপসারিত হওয়ার কথা তার। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, এখনো চাকরিতে বহাল রয়েছেন তিনি।
অভিযোগ রয়েছে, ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসে বিভিন্ন অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে তাকে চাকরি দেয় তৎকালীন আওয়ামীপন্থী উপাচার্য আবদুল মঈন।
সরকারি চাকরি (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮-তে বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মচারি পলায়নের দায়ে দোষী হলে তাকে তিরস্কার থেকে শুরু করে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান, চাকরি থেকে অপসারণ কিংবা বরখাস্ত করা হতে পারে।
একই বিধিমালার ২ (চ)তে বলা হয়েছে, বিনা অনুমতিতে ৬০ দিন বা তদূর্ধ্ব সময় কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকলে ওই কর্মচারি পলায়ন বলে গণ্য হবেন। সরকারের পট পরিবর্তনের আগে মাজেদ সর্বশেষ ১৬ জুলাই অফিস করেছেন বলে বিশ্ববিদ্যালয়সূত্রে জানা গেছে।
এরপর থেকে ছয় মাসেরও অধিক সময় পেরিয়ে গেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেননি তিনি। এমনকি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগও করেননি।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগের অনেক নেতাই দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। রেজাউল ইসলাম মাজেদ এখন কোথায় আছেন, সে সম্পর্কে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তার মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া যায়। তবে সবশেষ গত ১৩ আগস্ট শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে দেখা গেছে তাকে। তবে পুলিশি তৎপরতায় সেসময় তিনি দেশ ছেড়ে পালাতে পারেননি বলেই নিশ্চিত করেন সংশ্লিষ্ট সূত্র।
২০২৩ সালের অক্টোবরে মাজেদ ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ২০২৩ সালের ১৫ মে সেকশন অফিসারের বিপরীতে রেজাউল ইসলাম মাজেদসহ কয়েকজনের মৌখিক পরীক্ষা নেয় নিয়োগ বোর্ড। সভায় একক কোনো প্রার্থীর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় তিনজন প্রার্থীকে নিয়ে প্যানেল তৈরি করে বিষয়টি সিন্ডিকেটে নিয়ে যাওয়ার সুপারিশ করা হয়।
তবে ৪ অক্টোবর নিয়োগ বোর্ডের সভা বিবরণীতে স্বাক্ষরের জন্য বোর্ড সদস্য তৎকালীন উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হুমায়ুন কবিরকে পাঠালে তিনি শুধু একজনের সুপারিশ দেখতে পেয়ে সেখানে স্বাক্ষর না করার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর বিষয়টি সিন্ডিকেটে নেওয়া হলে সেখানেও তিনি আপত্তি (নোট অব ডিসেন্ট) জানান। এতকিছুর পরও তাকেই নিয়োগ দেন তৎকালীন আওয়ামীপন্থি উপাচার্য আবদুল মঈন।
অভিযোগ রয়েছে, ছাত্রনেতা থাকা অবস্থায় ভিন্নমত দমনের নামে প্রায়ই বিভিন্ন শিক্ষার্থীকে শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন করতেন রেজাউল ইসলাম মাজেদ। পান থেকে চুন খসলেই পেটাতেন নিজ দলের নেতাকর্মীদেরও। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাদককাণ্ডের নেতৃত্বেও ছিলেন তিনি। তার নির্যাতনের কারণে অনেক শিক্ষার্থীকেই হল ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে; বাদ দিতে হয়েছে পড়াশোনা। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কাজে নিয়মিত হস্তক্ষেপ, শিক্ষকদের নিয়ে কটূক্তি, উপাচার্যের গাড়ি আটকিয়ে অনৈতিক দাবি আদায়সহ রয়েছে আরও অনেক অভিযোগ।
সবচেয়ে বড় অভিযোগ, দলীয় অন্তঃকোন্দলে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী সাবেক ছাত্রলীগ নেতা খালেদ সাইফুল্লাহ হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত অন্যতম আসামি মাজেদ। ২০১৬ সালের ১ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে মোমবাতি প্রজ্জ্বলনকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের অন্তঃকোন্দলে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন মার্কেটিং বিভাগের ৭ম ব্যাচের এ শিক্ষার্থী। তিনি কাজী নজরুল ইসলাম হল ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন।
আওয়ামী সরকার ক্ষমতাচ্চ্যুত হওয়ার পরও এখনো মাজেদ বহাল তবিয়তে থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন খালেদ সাইফুল্লাহর মা ফাতেমা আক্তার। তিনি বলেন, মাজেদ আমার ছেলের খুনের মামলার চার্জশিটের ৩ নাম্বার আসামি হওয়া সত্ত্বেও বিশ্ববিদ্যালয়ে তার চাকুরি হওয়া এবং এখনো তাতে বহাল থাকা আমার মতো মায়েদের জন্য অপমান। আমি চাই এই খুনের বিচার দ্রুত হোক এবং মাজেদসহ অন্যান্য আসামিদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হোক।
সার্বিক বিষয়ে কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সোলাইমান বলেন, নিয়মানুযায়ী সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে। রেজিস্ট্রার দপ্তর থেকে আমার বরাবর এখনো কোনো ফাইল দেওয়া হয়নি। একজন কর্মকর্তা আইনের বাইরে আছেন কিংবা আইন অনুযায়ী কর্মস্থলে অনুপস্থিত আছেন, তখন আমাদের পক্ষ থেকে তার বেতনভাতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ করে দেওয়া হবে এবং আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।