অটোরিকশার ধাক্কায় জাবি ছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় মামলা, তদন্ত কমিটি
জাবি প্রতিনিধি
প্রকাশ: ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৯:০৯ পিএম
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) ব্যাটারিচালিত রিকশার ধাক্কায় প্রথম বর্ষের ছাত্রী আফসানা করিমের (রাচি) মৃত্যুর ঘটনায় এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে মামলা দায়ের করা হয়েছে।
বুধবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে সহকারী রেজিস্ট্রার (নিরাপত্তা বিভাগ) মোহাম্মদ আবু সৈয়দ থানায় অভিযোগ দায়ের করেন।
বৃহস্পতিবার আশুলিয়া থানার উপ-পরিদর্শক সোলায়মান অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মামলা গৃহীত হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন।
এছাড়া এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সাত সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। বুধবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার ড. এবিএম আজিজুর রহমান স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে এ তথ্য জানানো হয়। তদন্ত কমিটিকে আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
কমিটিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক মাসুম শাহরিয়ারকে আহবায়ক করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক আবু সাঈদ মোস্তাফিজুর রহমান, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক, গণিত বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আমিনা ইসলাম, মার্কেটিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আরিফুল হক এবং ডেপুটি রেজিস্ট্রার (সাধারণ প্রশাসন) মাহতাব-উজ-জাহিদ।
অনুষদ ফটকে তালা
আফসান করিম রাচির মৃত্যুর ঘটনায় এখন পর্যন্ত ঘাতক রিকশাচালককে গ্রেফতার করা হয়নি। ঘাতক রিকশাচালককে গ্রেফতারসহ ১১ দফা দাবিতে বিজনেস স্টাডিজ অনুষদে তালা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। বৃহস্পতিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে বিজনেস স্টাডিজ অনুষদে তালা দেওয়া হয়। পরে সেখান থেকে শিক্ষার্থীরা একটি বিক্ষোভ মিছিল নতুন প্রশাসনিক ভবনের সামনে এসে শেষ হয়। এরপর শিক্ষার্থীরা সেখানে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন।
তাদের উল্লেখযোগ্য দাবিগুলো হলো- অটোরিকশা চালককে গ্রেফতার করে সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনা, রাচিকে মরণোত্তর ডিগ্রি ও পরিবারকে ক্ষতিপূরণ প্রদান, সম্পূর্ণ ক্যাম্পাসে সিসিটিভি ক্যামেরার আওতায় আনা, পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা ও নিয়মিত মনিটরিং করা, পর্যাপ্ত সংখ্যক নিরাপত্তা কর্মী রাখা ও বহিরাগত প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা প্রদান, স্থায়ী স্মৃতিফলক নির্মাণ ও নির্মাণাধীন সেন্ট্রাল লাইব্রেরির একটি অংশের নাম রাচির নামে নামকরণ করতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ৫৩ ব্যাচের শিক্ষার্থী আলী চিশতি বলেন, ‘আমাদের বোন রাচির মৃত্যুর প্রতিবাদে এবং নিরাপদ ক্যাম্পাসের দাবিতে আমরা ১১ দফা দাবি দিয়েছি। দৃশ্যমান বাস্তবায়ন না দেখা পর্যন্ত আমাদের কর্মসূচি চলবে।
কালো ব্যাজ ধারণ কর্মসূচি
আফসানা রাচির মৃত্যুতে কালো ব্যাজ ধারণ কর্মসূচি পালন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। বৃহস্পতিবার দিনব্যাপী কালো ব্যাজ ধারণ কর্মসূচি পালন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগগুলোর শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
ক্যাম্পাসে ইজিবাইক-মোটরসাইকেল নিষিদ্ধ
আফসানা করিম রাচির মৃত্যুর ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ব্যাটারিচালিত রিকশা, ভ্যান, ইজিবাইক, নছিমন, করিমন, ভটভটি, মোটরসাইকেল এবং লাইসেন্সবিহীন সব যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে প্রশাসন। বুধবার রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার এবিএম আজিজুর রহমান স্বাক্ষরিত এক জরুরি বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়।
শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে বামপন্থি সংগঠক
এদিকে বুধবার রাতে আফসানা রাচি নিহতের ঘটনার বিচার চেয়ে করা মিছিলে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে ছাত্রফ্রন্টের সংগঠক সোহাগী সামিয়া ও ছাত্র ইউনিয়নের সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম ইমন প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েন।
শিক্ষার্থীদের দাবি- ২০২২ সালে এক শিক্ষার্থী আহত হওয়ায় ক্যাম্পাসে বেপরোয়া অটোরিকশা নিষিদ্ধ করা হয়। পরে বাম সংগঠনগুলোর দাবির মুখে আবার অটোরিকশা চালু হয়। তাই এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার অধিকার তারা হারিয়েছে।
এছাড়া বুধবার সকালে দিনভর চলা ‘জাহাঙ্গীরনগর ব্লকেড’ কর্মসূচিতে হস্তক্ষেপ করে ছাত্র ইউনিয়ন এবং ছাত্র ফ্রন্ট জাবি শাখার নেতাকর্মীরা। তাদের পরামর্শে একদল শিক্ষার্থী আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে মোড় দেওয়ার চেষ্টা করে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের অরাজনৈতিক আন্দোলনকে বাম সংগঠনগুলো দখল ও ভিন্নখাতে প্রবাহের চেষ্টা করলে আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া থেকে মুক্ত রাখতে তাদের প্রত্যাখ্যান করা হয় বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ মিনারে মাথায় সাদা কাপড় বেঁধে মিছিলের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীরা। এ সময় ছাত্রফ্রন্টের সংগঠক সোহাগি সামিয়া আন্দোলনের নেতৃত্ব দানের উদ্দেশ্যে বক্তব্য ও স্লোগান দিতে চান। তখন শিক্ষার্থীদের একজন বলে ওঠেন ‘আমরা এখানে আমাদের বান্ধবী হত্যার বিচার চাইতে এসেছি। কোনো রাজনীতি করতে আসি নাই। রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ এখানে চাই না।’
একপর্যায়ে ছাত্রফ্রন্টের ওই সংগঠককে জোর করে আন্দোলন থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়। তবে এ সময় সোহাগী সামিয়াকে শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য করে ‘সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেব’ বলে হুমকি দিতে ভিডিওতে দেখা যায়।
এ বিষয়ে মার্কেটিং ৪৯ ব্যাচের শিক্ষার্থী রেদোয়ান গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা এ পরিস্থিতি সামাল দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের পর দেখি আমাদের বোনের লাশ নিয়ে বিভিন্ন গ্রুপ আন্দোলন শুরু করেছে। আমরা স্পষ্টভাবে বলে দিতে চাই, আমরা আমাদের বোনের লাশকে নিয়ে রাজনীতি করতে দেব না।
আন্দোলনে হস্তক্ষেপের বিষয়ে ছাত্রফ্রন্ট সংগঠক সোহাগী সামিয়া বলেন, মার্কেটিং বিভাগের ৫২ ব্যাচের এক ছেলে আমাকে বারবার ফোন দিয়ে ডেকে নিয়ে আসে আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য। ৭টার দিক সেখানে এলে একটা সময় তার ফোন বন্ধ পাই। পরে ৫৩ ব্যাচের সিআরের সঙ্গে কথা বলি এবং তার সঙ্গে আন্দোলনে যোগদান করতে চাইলে তারা সম্মত হয়; কিন্তু কিছু ছেলে সামনে এসে স্লোগান দেয় আর বলতে থাকে ছাত্রফ্রন্ট তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য এখানে এসেছে। তখন তারা বলে এটা ৫৩ ব্যাচের আন্দোলন অন্য ব্যাচ অংশগ্রহণ করতে পারবে না। পরে আমাকে আন্দোলন যোগদান করতে বাধা দেয় এবং আমি সেখান থেকে চলে আসি।
এ বিষয়ে ছাত্র ইউনিয়নের সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম ইমন বলেন, আমাদের দাবি আর বিভাগের শিক্ষার্থীদের দাবি একই। তাদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে আমরা সেখানে গিয়েছিলাম। সেখানে একটা ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়।
সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক রাশিদুল আলম গণমাধ্যমকে বলেন, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে, আমরা সবার আগে চেষ্টা করছি অপরাধীকে শনাক্ত করে তার সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ইতোমধ্যে এ ঘটনায় থানায় অভিযোগ দায়ের করেছে। আর শিক্ষার্থীদের দাবিগুলো খুবই যৌক্তিক। ইতোমধ্যে আমরা অটোরিকশা ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ করেছি এবং বাকি দাবিগুলো বাস্তবায়নে কাজ করছি।