Logo
Logo
×

শিক্ষাঙ্গন

আদর্শ শিক্ষক: অধিকার ও কর্তব্য

Icon

প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবদুল হান্নান

প্রকাশ: ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ১১:০১ পিএম

আদর্শ শিক্ষক: অধিকার ও কর্তব্য

প্রফেসর ড. মোহাম্মদ আবদুল হান্নান।ছবি: যুগান্তর

শিক্ষকতা একটি মহৎ পেশা। সমাজ গঠনের মূল ভিত্তি হলো শিক্ষা, আর এই শিক্ষার মাধ্যমেই একজন মানুষ জীবনের সঠিক দিকনির্দেশনা পায়। শিক্ষকতা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব, যা শুধু জ্ঞান বিতরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং মানুষকে নৈতিক ও আত্মিক শিক্ষায় আলোকিত করাও শিক্ষকতার মূল উদ্দেশ্য। সমাজ গঠনে, প্রজন্মকে সঠিক পথনির্দেশনা দিতে এবং রাষ্ট্রের উন্নয়নে শিক্ষকের ভূমিকা অগ্রগণ্য। শিক্ষা ছাড়া জাতির উন্নতি সম্ভব নয়, আর এ শিক্ষাই মূলত শিক্ষকদের হাত ধরে আসে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষা ও দক্ষতা অর্জনে সাহায্য করেন এবং ভবিষ্যতের নেতৃত্ব তৈরিতে ভূমিকা রাখেন। এই দায়িত্বের পাশাপাশি তাদের নির্দিষ্ট কিছু অধিকারও রয়েছে, যা তাদের সঠিকভাবে পালন করার ক্ষেত্রে সহায়ক।

বাংলাদেশে শিক্ষকতা পেশা সবসময়ই মর্যাদার আসনে আসীন ছিল। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক, শিক্ষার মান এবং শিক্ষকদের দায়িত্ব নিয়ে নানা আলোচনা হয়েছে এবং চলছে। সমাজে শিক্ষকদের মর্যাদা যেমন উঁচুতে রাখা হয়, তেমনি তাদের থেকে প্রত্যাশার পরিমাণও অনেক বেশি। একজন আদর্শ শিক্ষককে শুধুমাত্র পাঠদানে নয় বরং নৈতিকতা, মূল্যবোধ এবং নেতৃত্ব প্রদানেও দক্ষ হতে হয়। বর্তমান বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার পরিবেশে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

শিক্ষকের অধিকার

অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে শিক্ষকদের জন্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা অপরিহার্য। অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা অন্যান্য পেশার তুলনায় কম বেতন পান, যা তাদের জীবনের মান উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। শিক্ষকদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য ন্যায্য বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা উচিত, যাতে তারা নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনে সুরক্ষা বোধ করতে পারেন এবং পেশাগত জীবনে মনোযোগী হতে পারেন। একজন শিক্ষক যদি তার অর্থনৈতিক দুশ্চিন্তায় থাকেন, তাহলে তিনি শিক্ষার্থীদের সঠিকভাবে দিকনির্দেশনা দিতে অক্ষম হতে পারেন।

পেশাগত স্বাধীনতা

শিক্ষকতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধিকারগুলোর মধ্যে একটি হলো পেশাগত স্বাধীনতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা গবেষণা, শিক্ষা এবং সমাজের বিভিন্ন বিষয়ে মতামত প্রকাশের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা ভোগ করেন। এই স্বাধীনতা তাদের নতুন নতুন চিন্তাধারাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করে এবং শিক্ষার্থীদের মেধার বিকাশ ঘটায়। তবে এই স্বাধীনতা তখনই অর্থবহ হবে যখন তা নৈতিকতা এবং সমাজের ভালোর জন্য ব্যবহৃত হবে।

গবেষণার সুযোগ

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য গবেষণা করার সুযোগ থাকাটা আবশ্যক। শিক্ষাবিদ হিসাবে তারা শুধু যে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান প্রদান করেন তা নয়, নিজেরাও গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেন। গবেষণা করার জন্য শিক্ষকদের পর্যাপ্ত সময় ও সুবিধা প্রদান করা হলে তারা নতুন ধারণা, প্রযুক্তি এবং সমস্যা সমাধানের পন্থা উদ্ভাবন করতে সক্ষম হন। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ সুযোগগুলোর পরিধি বাড়ানো প্রয়োজন।

শিক্ষকের কর্তব্য

শিক্ষার্থীদের উন্নত নৈতিকতা ও মূল্যবোধ শেখানো

একজন আদর্শ শিক্ষকের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হলো শিক্ষার্থীদের কেবলমাত্র পাঠ্যপুস্তকের জ্ঞান প্রদান নয়, বরং নৈতিক শিক্ষা প্রদান। আদর্শ শিক্ষক তাদের নিজেদের আচরণের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ সৃষ্টি করেন। তারা শুধু জ্ঞান বিতরণ করেন না বরং মানবিক গুণাবলীরও উদাহরণ হয়ে দাঁড়ান। যেমন, প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ এবং অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস শুধু একজন শিক্ষকই ছিলেন না, বরং নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং উদ্ভাবনী চিন্তাধারার মাধ্যমেও শিক্ষার্থীদের দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।

শিক্ষার গুণগত মান বজায় রাখা

একজন শিক্ষককে সর্বদাই শিক্ষার মান উন্নয়নে সচেষ্ট থাকতে হয়। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে আলোচনা হলে প্রথমেই শিক্ষকদের ভূমিকার কথা উঠে আসে। তারা শুধু শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় ভালো ফল করানোতেই সীমাবদ্ধ থাকবেন না বরং গবেষণা, সৃজনশীল চিন্তা এবং সমস্যার সমাধান করার ক্ষমতা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখবেন। শিক্ষার গুণগত মান বজায় রাখতে একজন শিক্ষককে তার পাঠদানের পদ্ধতি সময়োপযোগী করতে হবে এবং শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত করতে হবে।

গবেষণা ও উন্নয়নে অবদান রাখা

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অন্যতম দায়িত্ব হলো গবেষণায় অবদান রাখা। একজন আদর্শ শিক্ষক কেবলমাত্র নিজের কাজের জন্য নয় বরং শিক্ষার্থীদেরও গবেষণার প্রতি উৎসাহিত করেন। বাংলাদেশে অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার পরিমাণ খুবই কম, যা শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা এবং নতুন জ্ঞান সৃষ্টির পথে বাধা সৃষ্টি করে। তাই একজন আদর্শ শিক্ষক তার গবেষণার মাধ্যমে নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টির পাশাপাশি শিক্ষার্থীদেরও গবেষণায় অংশগ্রহণে উৎসাহিত করবেন।

শিক্ষার্থীদের মানসিক ও পেশাগত সহায়তা প্রদান

শিক্ষকরা শুধু শিক্ষার্থীদের পাঠদান করেই দায়িত্ব শেষ করেন না, তাদের মানসিক ও পেশাগত সহায়তাও প্রদান করতে হয়। একজন আদর্শ শিক্ষক শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার পাশাপাশি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও নজর রাখেন। একজন আদর্শ শিক্ষকের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো শিক্ষার্থীদের সঙ্গে একটি সহানুভূতিশীল সম্পর্ক গড়ে তোলা, যাতে তারা যেকোনো ধরনের সমস্যা নিয়ে তার সঙ্গে আলোচনা করতে পারে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একজন আদর্শ শিক্ষক তার অধিকার ও কর্তব্যকে সমন্বয় করে চলেন। তাকে অবশ্যই নৈতিক, পেশাগত এবং ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। শিক্ষকদের মানসিক ও অর্থনৈতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি শিক্ষার গুণগত মান বজায় রাখা এবং শিক্ষার্থীদের সর্বোত্তম দিকনির্দেশনা দেওয়ার ক্ষেত্রেও তাদের দায়িত্ব গুরুত্বপূর্ণ। একজন আদর্শ শিক্ষক শুধু নিজের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকেন না, বরং সমাজ, রাষ্ট্র, এবং বিশ্বের উন্নয়নে ভূমিকা রাখেন।

বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষকরা জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের উৎস হিসাবে কাজ করেন এবং তাদের নেতৃত্বের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা নিজেদের সর্বোচ্চ উন্নতি করতে সক্ষম হয়।  

লেখক: সাবেক ডিন, আইন অনুষদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়



Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম