প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠিতে যা লিখলেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা
ঢাবি প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০২ এপ্রিল ২০২৪, ০৯:২০ পিএম
লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতিমুক্ত ক্যাম্পাসের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাধারণ শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে লেখা এক খোলা চিঠিতে তারা এই দাবি জানান।
বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করাসহ পাঁচ দফা দাবিতে টানা চার দিন ধরে আন্দোলন করছেন শিক্ষার্থীরা। মঙ্গলবারও তারা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেন। এবার ক্যাম্পাস রাজনীতিমুক্ত করতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি লিখেছেন তারা। এদিন সন্ধ্যায় বুয়েট ক্যাম্পাসে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তারা এই খোলা চিঠি পাঠ করেন। এতে তারা বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে স্নাতক পর্যায়ে অধ্যয়নরত পাঁচ হাজারেরও অধিক শিক্ষার্থী আপনার প্রতি যথাযথ সম্মান ও শ্রদ্ধা রেখে সবিনয়ে দু-চারটি কথা এবং আমাদের আর্জি আপনার কাছে নিবেদন করছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি আমাদের স্বপ্নসারথি, বঙ্গবন্ধুর দর্শন অনুসরণ করে আপনি দৃঢ় পায়ে এগিয়ে চলেছেন। আপনি দেশকে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে এগিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে নিরলস শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। সেই একই স্বপ্ন বুকে ধারণ করে নিজেদের শ্রম-মেধা-মনন কাজে লাগিয়ে নিরঙ্কুশ অধ্যবসায়ের পর আপনার গর্বের এই দেশসেরা প্রতিষ্ঠানে আমরা পড়ার সুযোগ করে নিয়েছি।’
তাদের আবিষ্কারের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘আমরা করোনার সেই বিপদ মুহূর্তে বানিয়েছি লো-কস্ট ভ্যান্টিলেটর, ক্লিন সিটির আশায় পরিত্যক্ত মাস্ক থেকে বানাচ্ছি কংক্রিট, আরও খুঁজছি বিদ্যুতের সহজ উপায়, বানাচ্ছি আর্টিফিশিয়াল আর্মস, সার্জিক্যাল টুলস, পদ্মা সেতু নির্মাণে আমাদের বুয়েট শিক্ষক এবং সাবেক শিক্ষার্থীদের অবদান অনবদ্য। শুধু দেশেই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অন্য দেশের দলগুলো যাদের জন্য বরাদ্দ থাকে আমাদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি অর্থ এবং গবেষণাগারের সুবিধা, তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমরা ছিনিয়ে আনছি বিজয়। আপনি নিঃশর্তভাবে আমাদের অর্থ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন এসব গবেষণা খাতে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি আমাদের অভিভাবক। আমরা ত্রাসের রাজনীতির মারপ্যাঁচ বুঝি না, আমরা শুধু দেশকে, দেশের মানুষকে ভালোবাসতে জানি। নিজেদের কাজ দিয়ে তা আমরা প্রমাণ করতে বদ্ধপরিকর।’
তারা বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি মানবকল্যাণব্রতী, আপনি আমাদের সবার অভিভাবক, আপনি দেশের অভিভাবক। আমরা জানি দেশের কোথাও কোনো দুঃখজনক পরিস্থিতি চললে, দেশের কোথাও সংকট চললে, আপনার হৃদয়ে গভীর রক্তক্ষরণ হয়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, আশির দশকে স্বৈরাচার পতন আন্দোলনে এই দেশের আপামর জনগোষ্ঠীর মধ্যে জনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।’
ক্যাম্পাসের অপরাজনীতির কথা উল্লেখ করে তারা বলেন, ‘অথচ বিগত বছরগুলোতে আমরা বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতির নামে ক্ষমতার নেতিবাচক দিকগুলোই প্রত্যক্ষ করেছি। ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমেই শিক্ষার্থীদের মাঝে সূচনা ঘটেছে আধিপত্য, দাপট, র্যাগিং, শিক্ষকদের অপমান, চাঁদাবাজি, শিক্ষার্থী নিপীড়ন, খুনোখুনিতে মেতে ওঠার মতো ঘটনা। এর ব্যাপ্তি এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, এর চরমতম মূল্য হিসাবে আমরা আমাদের কেমিকৌশল ’৯৯-এর সাবেকুন্নাহার সনি আপু, যন্ত্রকৌশল ’০৯-এর আরিফ রায়হান দ্বীপ ভাই এবং সর্বশেষ তড়িৎকৌশল ’১৭-এর আবরার ফাহাদ ভাইকে হারিয়েছি। শুধু আবরার ফাহাদ ভাইয়ের হত্যাকাণ্ডই নয়, এর আগেও অসংখ্য শিক্ষার্থীকে র্যাগিংয়ের দ্বারা কিংবা ছাত্র রাজনীতির দাপটের দ্বারা অমানুষিকভাবে নিপীড়িত হওয়ার ঘটনা রয়েছে। যা আমাদের বুয়েটের র্যাগিং স্টোরি আর্কাইভে সারি সারি আকারে লিপিবদ্ধ আছে। বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার শাহরিয়ারকে স্টাম্প দিয়ে রাতভর বেধড়ক মারধর করা হয়। ১৭ ব্যাচের মেহজাদ গালিবকে নগ্ন করে সোহরাওয়ার্দী হলের ছাদে তুলে স্টাম্প দিয়ে সারা রাত মারা হয়, ১৫ ব্যাচের সামিউত তৌসিফকে মেরে হাত-পা ভেঙে দেয়। মারতে মারতে তিনটা স্টাম্প ভেঙে ফেলা হয়। এই সামিউত তৌসিফ ছিল এক মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান, তার চাচা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে শহিদ। তার লিগামেন্ট ছিঁড়ে পায়ে ফ্র্যাকচার হয়ে যায়। সালাম না দেওয়াতে সাখাওয়াত অভির হাত ভেঙে ফেলে আবরার ফাহাদের হত্যাকারী অমিত সাহা। সৌমিত্র লাহিড়ী থাপ্পড় দিয়ে কানের পর্দা ফাটিয়ে ফেলে একজনের, এ রকম আছে আরও অসংখ্য কাহিনি।’
মৌলবাদী শক্তিকে প্রতিহত করার দাবি জানিয়ে তারা বলেন, সাম্প্রতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক মহল থেকেই বলা হচ্ছে যে, ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ মৌলবাদী বা সন্ত্রাসী সংগঠনের কার্যক্রম বিদ্যমান। এর ফলে তারা বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি চর্চার পক্ষে যুক্তি দিয়ে যাচ্ছেন। আমরা আপনাকে নির্দ্বিধায় বলতে চাই, আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা যদি যে কোনো মুহূর্তে এসব নিষিদ্ধ সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর যে কোনো কার্যকলাপ ক্যাম্পাসে চলমান দেখি শিগগিরই তার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেব এবং প্রশাসনকে অবহিত করব। এমনকি ভবিষ্যতে যদি ক্যাম্পাসে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে সেটার বিরুদ্ধেও আমাদের অবস্থান হবে দৃঢ়।