Logo
Logo
×

শিক্ষাঙ্গন

অবন্তিকার সহপাঠী ও সহকারী প্রক্টর আটক

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন ও কুমিল্লা ব্যুরো

প্রকাশ: ১৬ মার্চ ২০২৪, ১০:২৩ পিএম

অবন্তিকার সহপাঠী ও সহকারী প্রক্টর আটক

সহপাঠী রায়হান সিদ্দিকী আম্মান (বামে) ও সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম।

আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের আলটিমেটামের ৬ ঘণ্টার মধ্যেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার আত্মহত্যার প্ররোচনায় সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম ও সহপাঠী রায়হান সিদ্দিকী আম্মানকে আটক করেছে পুলিশ। শনিবার রাতে ঢাকা মহানগর লালবাগ বিভাগের কোতোয়ালি থানা পুলিশের একটি দল তাদের আটক করে। বিষয়টি যুগান্তরকে নিশ্চিত করেছে পুলিশের লালবাগ বিভাগের দায়িত্বশীল সূত্র। এর আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনার পর থেকেই এ দুজনকে নজরদারিতে রেখেছিল পুলিশ। ছাত্রদের আন্দোলন তীব্র হওয়ায় অভিযোগের বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদের আটক করা হয় বলে জানা গেছে। 

এদিকে শিক্ষক দ্বীন ইসলাম ও সহপাঠী আম্মানকে অভিযুক্ত করে অবন্তিকার মা তাহমিনা শবনম আত্মহত্যা প্ররোচনার অভিযোগে কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানায় মামলা করেছেন। শনিবার রাত ৮টায় কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানায় এ মামলা করেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ফিরোজ হোসেন। তিনি বলেন, অবন্তিকার মা তাহমিনা শবনম বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করেছেন।

শ্রেণিকক্ষে সহপাঠীর দ্বারা নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ছাত্রী ফাইরুজ অবন্তিকা। এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অফিসে লিখিতভাবে অভিযোগও জানিয়েছিলেন তিনি। তবে কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উলটো তাকে ছাত্রত্ব হারানোর ভয়ভীতি দেখানো হয়। অপরদিকে তার বিরুদ্ধে বিভাগের কয়েকজন সহপাঠী শিক্ষকদের কাছে অভিযোগ করেছিলেন। সেখানে সামাজিক মাধ্যমে তাদের হয়রানির অভিযোগ করা হয়। উভয় পক্ষের অভিযোগ ও পালটা অভিযোগ নিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন অবন্তিকা। এরই মধ্যে মারা যান তার বাবা। এতে তিনি আরও ভেঙে পড়েন। অপরদিকে প্রক্টর অফিসে দেওয়া অভিযোগেরও কোনো নিষ্পত্তি হয়নি। উলটো তাকে এমন সব পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে, যার কারণে চরম হতাশ হয়ে পড়েন অবন্তিকা। বেছে নেন আত্মহননের পথ। পরিবার, বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী, শিক্ষক এবং পুলিশের সঙ্গে কথা বলে এসব বিষয় জানা গেছে।

শুক্রবার রাতে কুমিল্লার বাড়িতে একটি ফেসবুক পোস্টে দুজনকে দায়ী করে সিলিং ফ্যানে ঝুলে আত্মহনন করেন অবন্তিকা। এ দুজন হলেন জবির সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম এবং সহপাঠী আম্মান। এর আগে দ্বীন ইসলামকে সহকারী প্রক্টরের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। অভিযুক্ত ছাত্রকে গ্রেফতারের নির্দেশনা দেন উপাচার্য। পাশাপাশি এ ঘটনায় পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে সাতদিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এদিকে অবন্তিকার আত্মহনন প্ররোচনায় জড়িতদের গ্রেফতারসহ ছয় দফা দাবি জানিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। দাবি পূরণে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটামও দেওয়া হয়েছে। জানা যায়, ছাত্রদের দাবির মুখে আটক হয়েছেন অভিযুক্ত সহকারী প্রক্টর ও শিক্ষার্থী। অবন্তিকার আত্মহত্যার পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। শুক্রবার রাত ৩টা পর্যন্ত ক্যাম্পাসে অবস্থান নিয়ে এ ঘটনার বিচার দাবি করেন তারা। শনিবার সকালে বিক্ষোভ এবং বিকালে মানববন্ধন করে দায়ীদের শাস্তি দাবি করেন তারা। ঘটনাটি নির্মোহভাবে তদন্ত করে এর পেছনে যাদেরই দায় থাকুক, তাদের খুঁজে বের করারও দাবি জানান তারা। এজন্য ছয় দফা দাবি পেশ করেন তারা। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দাবিগুলো মানা না হলে সোমবার বেলা ১১টায় উপাচার্য কার্যালয় ঘেরাওয়ের হুঁশিয়ারি দেন তারা। শনিবার বিকাল সাড়ে ৩টায় ‘নিপীড়নের বিরুদ্ধে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়’ শীর্ষক ব্যানারে আয়োজিত বিক্ষোভ মিছিলে শিক্ষার্থীরা ছয় দফা দাবি তুলে ধরেন। 

দাবিগুলো হলো- হত্যার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করা; আম্মানের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা এবং দ্বীন ইসলামকেও অবিলম্বে গ্রেফতার ও সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা; জরুরি সিন্ডিকেট সভা ডেকে অভিযুক্তদের স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করা এবং ভুক্তভোগী পরিবারের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এছাড়া আরও তিনটি দাবি জানিয়েছেন তারা। এর মধ্যে রয়েছে- অভিযুক্তদের বহিষ্কার করা; বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে বাদী হয়ে মামলা দায়ের করা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী নিপীড়নবিরোধী সেল কার্যকর করা।

এদিকে শনিবার কুমিল্লা শাসনগাছা এলাকায় পারিবারিক কবরস্থানে বাবার পাশে তাকে সমাহিত করা হয়। এর আগে অবন্তিকার লাশের গাড়ি দেখে জ্ঞান হারিয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন মা তাহমিনা শবনম। শুক্রবার রাতে তার মৃত্যুর পর শনিবার বেলা ১টার দিকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গ থেকে তার লাশ আনা হয় নিজ বাড়িতে। এ সময় ফায়ার সার্ভিস এলাকাজুড়ে কান্নার রোল ওঠে। লাশে গাড়ি দেখেই এগিয়ে আসেন স্বজন ও প্রতিবেশীরা। এ সময় অবন্তিকার মা তাহমিনা শবনমকে বলতে শোনা যায়, ‘আল্লাহ সবাইকে নিয়ে যায়, আমাকে কেন নেয় না। মারতে মারতে আল্লাহ আমার স্বামীও নিল, মেয়েও নিল। এ আমি কার লাশ দেখছি? এটা তো আমার তিল তিল করে গড়ে ওঠা স্বপ্নের লাশ দেখছি।’ এসব বলতে বলতে সংজ্ঞা হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি।

অপরদিকে আলোচিত এ আত্মহত্যার ঘটনার পর বিষয়টি নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষক, অবন্তিকার চার সহপাঠী এবং প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে যুগান্তর। এতে জানা যায়, মূলত কয়েকটি বিষয় ঘিরে অবন্তিকার সঙ্গে সহপাঠীদের তিক্ততার সম্পর্ক তৈরি হয়। প্রথম বর্ষে ভর্তির পর তিনি জিডি পাইলট হিসাবে যোগ দেন। এর কিছুদিন পর সেখান থেকে তিনি চলে আসেন। এতে তিনি এক শিক্ষাবর্ষ পিছিয়ে যান। ফলে জুনিয়র ব্যাচের সঙ্গেই তাকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে হয়। এ নিয়ে শুরু থেকেই কিছুটা অস্বস্তিতে ছিলেন তিনি। এছাড়া তিনি বিভাগের ফার্স্ট গার্ল হওয়ায় সহপাঠীদের কাছে আক্রোশের শিকার হন। এসব অস্বস্তি একসময় তিক্ততার পর্যায়ে চলে যায়। অবন্তিকা একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলে সহপাঠীদের নিয়ে বিভিন্ন নেতিবাচক মন্তব্য করেন বলে তখন অভিযোগ করেছিলেন তার সহপাঠীরা। বিষয়টি তার পরিবার পর্যন্ত গড়ায়। এতে সহপাঠীদের সঙ্গে তার সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে। শ্রেণিকক্ষেও একা হয়ে পড়েন তিনি। এসব নিয়ে বিভিন্ন সময়ে ইশারা-ইঙ্গিতে তাকে কটূক্তি ও হেয়ও করা হয়। এ নিয়ে অবন্তিকা বিভাগ ও প্রক্টর অফিসে লিখিত অভিযোগ দেন। তবে এগুলো কার্যকরভাবে সমাধান হয়নি। সেসময় প্রক্টরের দায়িত্বে ছিলেন ড. মোস্তফা কামাল। তিনি এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে উলটো অবন্তিকাকে বিভিন্ন ধরনের ভয়ভীতি দেখান। পরে এ ঘটনা নিয়ে সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের সঙ্গে আলাপ করলে তিনি আম্মানের হয়ে অবন্তিকাকে নানাভাবে ভয় দেখান। এমনকি তাকে (অবন্তিকা) বহিষ্কার করার হুমকি দেন এই শিক্ষক। ফলে ঘটনা এতদূর গড়ায়। 

এদিকে অবন্তিকার আত্মহননের ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে চায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন যুগান্তরকে বলেন, ইতোমধ্যে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের দ্রুত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। আমাদের দুজন শিক্ষক কুমিল্লায় ওই শিক্ষার্থীর নিজ বাসায় গেছেন। 

পরিবার যদি মামলা করতে চায়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ আইনি সহায়তা দেওয়া হবে বলে জানান তিনি। 

উপাচার্য অধ্যাপক সাদেকা হালিম জানান, দোষীদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনা হবে। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী ঘটনায় জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া হবে। এছাড়া এর আগে ঘটে যাওয়া প্রতিটি ঘটনা আগামী সিন্ডিকেটে উত্থাপন করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি। 

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ড. ফওজিয়া মুসলিম বলেন, আমরা অবাক হচ্ছি এজন্য যে, বারবার এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি যথাযথ ব্যবস্থা নিত, তাহলে হয়তো এ ধরনের ঘটনা ঘটত না। আমরা এ ঘটনায় অন্যান্য জড়িতদেরও গ্রেফতার করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি। আমরা বিষয়টি জেনেছি। অফিস খুললেই উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। ছাত্রী তার মৃত্যুর জন্য দায়ী হিসাবে আমাদের প্রক্টরিয়াল টিমের একজন সদস্যদের নাম উল্লেখ করেছে। উপাচার্য সাময়িকভাবে তাকে অব্যাহতির মৌখিক নির্দেশনা দিয়েছেন। আইনগত প্রক্রিয়ায় তদন্তসাপেক্ষে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাবার পাশেই সমাহিত অবন্তিকা: শনিবার বিকালে কুমিল্লা সরকারি কলেজ মাঠে ফাইরুজ অবন্তিকার জানাজা সম্পন্ন হয়েছে। জানাজা শেষে তার মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় শাসনগাছা এলাকায়। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে বাবার পাশে সমাহিত করা হয় অবন্তিকাকে। তার জানাজায় অংশ নেন আইন বিভাগের শিক্ষক সহযোগী অধ্যাপক মিফতাহুল হাসান, অবন্তিকার ভাই অপূর্বসহ সরকারি কলেজের কয়েকজন শিক্ষক ও স্বজনরা। 

এদিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী অবন্তিকার মৃত্যুর পর তার পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে এবং বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করতে কুমিল্লায় এসেছেন প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্যরা।

এ সময় তারা অবন্তিকার মা ও স্বজনদের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথা বলেন এবং এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়র আশ্বাস দেন। পরে প্রক্টরিয়াল টিমের সদস্য আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুনিরা জাহান সুমি সাংবাদিকদের বলেন, যা ঘটে গেছে তা আমাদের কাম্য ছিল না। ইতোমধ্যে অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষার্থী রায়হান সিদ্দিকী আম্মানকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে এবং শিক্ষক দ্বীন ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করার পাশাপাশি সহকারী প্রক্টরের পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় আরও যা যা ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, সবই করা হবে, জানান মুনিরা জাহান সুমী। 

এদিকে অবন্তিকার আত্মহননে বাধ্য করার সঙ্গে যুক্তদের দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে বিভিন্ন সংগঠন নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে। এর মধ্যে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট এ ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম