সন্ত্রাস ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে আবরারের সহপাঠীদের শপথ। বুধবার বুয়েট মিলনায়তনে। ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। গত ১৪ অক্টোবর ভর্তি পরীক্ষা ছাড়া সব ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অচল হয়ে পড়েছে বুয়েট।
সহপাঠীকে হারিয়ে শোকে কাতর বুয়েট শিক্ষার্থীরা। কিছুতেই ভুলতে পারছেন না আবরারের স্মৃতি। তাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ বইয়ে চলেছে। প্রতিবাদ-প্রতিশোধের অনল এখন দাউ দাউ করে জ্বলছে তাদের মানসপটে। মানুষরূপী পশুগুলোর (আবরারের খুনি) প্রতি শিক্ষার্থীদের ধিক্কার।
আজ থেকে মাঠের আন্দোলন স্থগিত করলেও লেখাপড়ায় মন বসাতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। হৃদয়ের ক্ষত যে এখনও শোকায়নি। ঘোষণা দিয়েছে, আবরার হত্যা মামলার এজাহারে নাম থাকা সব খুনি গ্রেফতার এবং তাদেরকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ী বহিষ্কার না করা পর্যন্ত শ্রেণীকক্ষে ফিরে যাবে না তারা। অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ থাকবে।
এমন পরিস্থিতিতে বুয়েটর উপাচার্য অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম সন্ত্রাস ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে গণশপথ শেষে বলেছেন, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। আমরা ছাত্রদের বুঝানোর চেষ্টা করছি। আপনারা একটু ধৈর্য্য ধরুন। আশাকরি একটা ভালো রেজাল্ট আসবে। অনেক দূর এগিয়ে এসেছি। সব ঠিক হয়ে যাবে।
আসলে কি সবকিছু ঠিক হবে? সবই কি ঠিক হবে? এই প্রশ্ন বুয়েট শিক্ষার্থীদের মনে। আবরারের সহপাঠী ও হলের বন্ধুরা এখন আশা নিরাশার দোলাচলে। আবরার হত্যার সঠিক বিচার হবে কিনা সে বিষয়ে তারা সন্দিহান। কারণ খুনিরা ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগের সক্রিয় নেতাকর্মী। তাদের বাঁচানোর চেষ্টা চলছে নানাভাবে। প্রধানমন্ত্রী আবরারের খুনিদের বিচার করার কথা বললেও পর্দার অন্তরালে তাদের বাঁচানোর চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ বুয়েটিয়ানদের।
এ কারণেই বুয়েট শিক্ষার্থীরা ঘোষণা দিয়েছে, আবরারের খুনিদের গ্রেফতার ও তাদের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থায়ী বহিষ্কার না করা পর্যন্ত ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকবে।
তবে বুয়েট ভিসি সাইফুল মনে করেন শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফেরা উচিত। তার ভাষ্য, চার্জশিটের জন্য ক্লাসে ফিরতে এতদিন দেরি করলে সবার সমস্যা হবে। আমরা ছাত্রদের বুঝানোর চেষ্টা করছি।
আবরারের খুনিরা না হয় গ্রেফতার হলেন, তাদের বুয়েট থেকে বহিষ্কারও করা হলো কিন্তু আবরারকে কি ফিরে পাবে তার বন্ধুরা। তার মা-বাবার-ই বা কী হবে? তাদের সান্তনা কী থাকল?
ছাত্রসংগঠনের এমন নৃশংসতা কী আবরারকে বলি দেয়ার মধ্য দিয়েই শেষ হয়ে যাবে? শিক্ষাঙ্গনে আর কি কোনো আবরার ট্রাজেডি ঘটবে না? এসব প্রশ্ন এখন নিযুত শিক্ষার্থীদের।
প্রসঙ্গত ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি নিয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেয়ায় খুন হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ। ভারতের সঙ্গে চুক্তির বিরোধিতা করে ৫ অক্টোবর শনিবার বিকালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দেন ফাহাদ। এর জের ধরে ৬ অক্টোবর রাতে শেরেবাংলা হলের নিজের ১০১১ নম্বর কক্ষ থেকে তাকে ডেকে নিয়ে ২০১১ নম্বর কক্ষে বেধড়ক পেটানো হয়। এতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। পিটুনির সময় নিহত আবরারকে ‘শিবিরকর্মী’ হিসেবে চিহ্নিত করার চেষ্টা চালায় খুনিরা।
তবে আবরার কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন না বলে নিশ্চিত করেছেন তার পরিবারের সদস্যসহ সংশ্লিষ্টরা।
হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ না রাখতে সিসিটিভি ফুটেজ মুছে (ডিলিট) দেয় খুনিরা। তবে পুলিশের আইসিটি বিশেষজ্ঞরা তা উদ্ধারে সক্ষম হন। পুলিশ ও চিকিৎসকরা আবরারকে পিটিয়ে হত্যার প্রমাণ পেয়েছেন।
আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় তার বাবা বরকত উল্লাহ বাদী হয়ে চকবাজার থানায় ১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। ইতিমধ্যে পুলিশ ২০ জনকে গ্রেফতার করেছে। ১৩ জনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে পুলিশ। রোববার পর্যন্ত চারজন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন।
গ্রেফতার আসামিরা হলেন- বুয়েট শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান ওরফে রাসেল, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ফুয়াদ হোসেন, অনীক সরকার, মেফতাহুল ইসলাম জিয়ন, ইফতি মোশারেফ, বুয়েট ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান ওরফে রবিন, গ্রন্থ ও প্রকাশনা সম্পাদক ইশতিয়াক আহমেদ ওরফে মুন্না, ছাত্রলীগের সদস্য মুনতাসির আল জেমি, খন্দকার তাবাখখারুল ইসলাম ওরফে তানভীর, মোহাজিদুর রহমানকে, শামসুল আরেফিন, মনিরুজ্জামান ও আকাশ হোসেন, মিজানুর রহমান (আবরারের রুমমেট), ছাত্রলীগ নেতা অমিত সাহা এবং হোসেন মোহাম্মদ তোহা এবং মঙ্গলবার গ্রেফতার হয়েছেন এ এস এম নাজমুস সাদাত।
এদের মধ্যে ১৩ জনকে স্থায়ী বহিষ্কার করেছে ছাত্রলীগ। আর ১৯ জনকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে।
আবরার হত্যার ঘটনায় বুয়েট শিক্ষার্থীরা খুনিদের সর্বোচ্চ শাস্তি, বুয়েট ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করাসহ ১০ দফা দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে গত শুক্রবার সন্ধ্যায় বুয়েট ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন উপাচার্য অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম। বুয়েটের কোনো শিক্ষার্থী ছাত্ররাজনীতিতে জড়িত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ঘোষণাও দেন তিনি। তবে শিক্ষার্থীরা বলছেন, কেবল আশ্বাস নয়, বাস্তবায়নও দেখতে চান তারা।