২৫ লাখ টাকা ঈদ সালামি পেয়েছি: জাবি ছাত্রলীগ নেতা তাজ
যুগান্তর রিপোর্ট
প্রকাশ: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯, ০৫:২৬ এএম
জাবি ছাত্রলীগের সহ সভাপতি নিয়ামুল হাসান তাজ।ছবি: সংগৃহীত
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নকাজে দুর্নীতির অভিযোগ আরও পাকাপোক্ত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগ। ঈদের আগে উপাচার্য ফারজানা ইসলামের কাছ থেকে ছাত্রলীগ ১ কোটি টাকা সালামি পেয়েছে বলে সংগঠনটির একাধিক নেতা স্বীকার করেছেন।
ওই ১ কোটি টাকা থেকে ২৫ লাখ টাকার ভাগ পেয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন জাবি ছাত্রলীগের সহসভাপতি নিয়ামুল হাসান তাজ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ঈদের আগে এক কোটি টাকার চাঁদা থেকে আমি ও সাদ্দাম (জাবি ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক) ২৫ লাখ টাকার ভাগ পেয়েছি।
তিনি বলেন, এ টাকা আমরা কীভাবে পেয়েছি, সেটা জানি; কিন্তু বাকি টাকার কারা কত পেয়েছে, তা জানি না। এখন যেহেতু প্রশাসনের বিরুদ্ধে বড় অঙ্কের দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তাই এটা তদন্ত হওয়া উচিত। প্রশাসন কত টাকার দুর্নীতি করেছে, তা প্রমাণ হওয়া উচিত।
সোমবার সন্ধ্যায় যুগান্তরের সঙ্গে মুঠোফোনে ছাত্রলীগ নেতা তাজ আরও জানান, ঈদ সালামি হিসেবে ২৫ লাখ টাকা পেয়েছেন। প্রতি ঈদেই তারা সালামি পান, এবারও পেয়েছেন। তবে এবার বেশি পেয়েছেন।
তিনি বলেন, এই সালামির টাকা প্রশাসন কোথা থেকে দিয়েছে, তা আমাদের জানা নেই। যদি এটি দুর্নীতির টাকা হয় তবে সেটি তদন্তের দাবি করছি। এর আগে সোমবার দুপুরে গণমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে এই দুর্নীতির বিষয়ে স্বীকারোক্তি দেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহসভাপতি নিয়ামুল হাসান তাজ।
এ সময় তিনি বলেন, ‘আমাদের বলা হয়েছে, তোমরা (তাজ ও সাদ্দাম) ২৫ লাখ নিবা, জাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক চঞ্চল ২৫ লাখ নিবে আর সভাপতি মো জুয়েল রানা ৫০ লাখ নিবে। আমরা আমাদেরটা পেয়েছি। তবে অপ্রকাশ্যে এর বেশি কে কত পেয়েছে, তা আমরা জানি না। কেউ এর বেশিও পেতে পারে।’
১৩ সেপ্টেম্বর শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে সদ্য সাবেক কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীর কথোপকথনের একটি ফোনালাপ ফাঁস হয়েছে রোববার। সেখানে সাদ্দাম ও তাজের ২৫ লাখ টাকা পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হয়।
একই সঙ্গে লেনদেন হওয়া মোট এক কোটি টাকার দুর্নীতির হিসাব দেখান সাদ্দাম। এছাড়া এই দুর্নীতির সঙ্গে ভিসির ছেলে, স্বামী, একান্ত সচিব ও প্রকল্প পরিচালকের সম্পৃক্ততা দেখানো হয়।
শাখা ছাত্রলীগ ও প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ঈদের আগে ৯ আগস্ট ভিসির বাসভবনে প্রশাসনের সঙ্গে ৪ ছাত্রলীগ নেতার আলোচনা হয়। সেখানে এক কোটি টাকা ভাগবাটোয়ারা হয়। তাদের মধ্যে নিয়ামুল হাসান তাজ ও সাদ্দাম হোসেন ছিলেন। এরা দু’জন গোলাম রাব্বানীকে অনুসরণ করতেন।
এদিকে ফাঁস হওয়া কথোপকথনে যে দুর্নীতির কথা বলা হয়েছে, সেটিকে মিথ্যা-ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত দাবি করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সোমবার বিকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ অফিস থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ দাবি করা হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের সঙ্গে ছাত্রলীগ নেতাদের মধ্যে টাকা ভাগের কোনো আলাপ হয়নি। তিনি কাউকেই অর্থ প্রদান করেননি। গোলাম রাব্বানী উপাচার্য মহোদয়কে বিতর্কিত করার জন্য ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে এই ফোনালাপের গল্প তৈরি করেছেন।
প্রশাসনের এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার গণমাধ্যমের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে জাবি ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন ২৫ লাখ টাকা পাওয়ার কথা আবারও স্বীকার করেন।
তিনি বলেন, প্রশাসন দাবি করছে আমরা মিথ্যা গল্প বলছি। তাই পাল্টাপাল্টি অভিযোগ না করে প্রশাসনের সঙ্গে আমাদের কী কনভারসেশন (আলোচনা) হয়েছে, সেটি বের করলেই ক্লিয়ার (পরিষ্কার) হয়ে যাবে।
তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘আমি আবারও বলছি, ভিসির ছেলের সঙ্গে আমার ও তাজের ৯ আগস্টের আগে ও পরে কী কনভারসেশন (মুঠোফোনে কথোপকথন) হয়েছে, সেগুলো বের করা হলে সবকিছু ক্লিয়ার হয়ে যাবে- এই দুর্নীতির সঙ্গে কে জড়িত এবং কে কত টাকা পেয়েছে। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যদি চায় বিষয়টি উদ্ঘাটন করবে তবে আমরা সর্বোচ্চ সহযোগিতা করব।
আন্দোলন দমাতে প্রশাসন শাখা ছাত্রলীগকে এক কোটি টাকা দেয় বলে সংগঠনের সহসভাপতি হামজা রহমান অন্তর স্বীকারও করেছেন। তিনি বলেন, জাবিতে অপরিকল্পিত উন্নয়নের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছে।
এটা ঠেকাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শাখা ছাত্রলীগকে এক কোটি টাকা দেয়। এ বিষয়ে সোমবার গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, ক্যাম্পাসে ভিসি, তার স্বামী, ছেলে এবং প্রশাসনের মধ্যস্থতায় শাখা ছাত্রলীগকে এক কোটি টাকা দেয়া হয়। আমাকেও ঈদ সেলামির নামে টাকা অফার করা হয়। কিন্তু আমার সন্দেহ হওয়ায় টাকা নিতে রাজি হইনি।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামী ও ভিসিপন্থী শিক্ষকদের সংগঠন ‘বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদ’ রাব্বানী-সাদ্দামের ফোনালাপকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, কল্পিত কাহিনী ও চক্রান্তমূলক দাবি করে।
সোমবার বিকালে এক বিজ্ঞপ্তিতে সংগঠনটির সভাপতি অধ্যাপক আবদুল মান্নান ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক বশির আহমেদ স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে এ দাবি জানানো হয়। এতে বলা হয়, একটি গোষ্ঠীর স্বার্থ হাসিল না হওয়ায় তারা ভিসির বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে।
ঈদ সালামি হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ছাত্রলীগকে ১ কোটি টাকা দিয়েছে বলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন যে দাবি করেছেন, সেটি প্রত্যাখ্যান করেছেন উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম। তিনি বলেছেন, সাদ্দাম মিথ্যা বলছেন, তিনি এই মিথ্যা বলা বন্ধ না করলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এর আগে চাঁদাবাজির অভিযোগে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদ থেকে অপসারিত হওয়া গোলাম রাব্বানী অভিযোগ করেন, জাবির উন্নয়ন প্রকল্পে বাধা হয়ে না দাঁড়ানোর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগকে ভিসি ফারজানা ইসলাম ১ কোটি ৬০ লাখ টাকা দিয়েছেন। অন্যদিকে উপাচার্য অভিযোগ করেন, তিনি কোনো টাকা দেননি। বরং রাব্বানী ও ছাত্রলীগের বরখাস্ত হওয়া সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন তার কাছে কয়েক দফায় উন্নয়ন প্রকল্পের বাজেট থেকে ৪ থেকে ৬ শতাংশ টাকা ঈদ সালামি দাবি করেন।
এ বিষয়ে জাবি শাখা ছাত্রলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, উপাচার্য ম্যাম আমাদের এক কোটি টাকা দিয়েছেন ঈদ সালামি বাবদ। সভাপতি জুয়েল ভাই ৫০ লাখ, সাধারণ সম্পাদক চঞ্চল ভাই ২৫ লাখ, আর আমি নিছি ২৫ লাখ। কে কয় টাকা নেব এটাও ভিসি ম্যাডাম ঠিক করে দিছেন।
ঈদ সালামি হিসেবে ছাত্রলীগ এক কোটি টাকা কেন নেবে এমন প্রশ্নের জবাবে সাদ্দাম বলেন, ‘ভাই, আমাকে দিছে। ঈদ সালামি বলে আমি নিছি। আমার পোলাপান আছে। রাজনীতি করি টাকার দরকার আছে। কেউ যদি ঈদ সালামি দেয় আপনি নেবেন না? ভিসি কোথা থেকে এত টাকা সালামি দিয়েছেন এমন প্রশ্নে সাদ্দাম বলেন, কোথায় থেকে এই টাকা ম্যাম আমাদের দিয়েছেন, তা আমরা জানি না। এক কোটি টাকা ঈদ সালামি পেয়ে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে ভাগ করে দিয়েছি আমরা।
সাদ্দামের এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন ভিসি ফারজানা ইসলাম। তিনি বলেন, আমি শুরু থেকে বলে আসছি, আমি কাউকে চাঁদা দেইনি। তবে কেউ যদি বলে টাকা পেয়েছে, তাহলে পেতে পারে। আমি দিইনি। আমি টাকা দিয়েছি এটা পারলে ও (সাদ্দাম) প্রমাণ করুক। যেখান থেকে ও পেয়েছে, এটাও বলুক, ওকে বলতে দেন।