ছবি: সংগৃহীত
প্রস্তাবিত বাজেটে ব্যাংক খাতের সমস্যা নিয়ে খুব বেশি আলোচনা করা হয়নি। বিশেষ করে এ খাতের সবচেয়ে বড় সমস্যা খেলাপি ঋণ আদায় এবং বিদেশে পাচার করা টাকা ফিরিয়ে আনার বিষয়েও কিছুই বলা হয়নি। এছাড়া মূল্যস্ফীতি কমানো এবং বিনিয়োগ বাড়ানোর কথা বলা হলেও কীভাবে তা করবে তার কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা নেই। তবে এই বাজেটে অনেক ইতিবাচক দিক রয়েছে, কিন্তু বাজেট বাস্তবায়ন করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ হবে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর এক আলোচনাসভায় এসব কথা বলেন দেশের শীর্ষ অর্থনীতিবিদরা।
শনিবার ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ব্র্যাক বিজনেস অ্যান্ড ইকোনমিকস ফোরাম এ আলোচনাসভার আয়োজন করে। এতে অংশ নেন ব্র্যাক বিজনেস স্কুলের প্রফেসর এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম, ব্র্যাক বিজনেস স্কুলের প্রফেসর এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর প্রফেসর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, আইপিডিসি ফিন্যান্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোমিনুল ইসলাম এবং স্নেহাশিষ মাহমুদ অ্যান্ড কোংয়ের অংশীদার স্নেহাশিষ বড়ুয়া, এফসিএ।
এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব দেশেই বাজেট বড় হয়। বাংলাদেশেও হচ্ছে। জিডিপির অনুপাতে এটা অনেক কম। তাই এটাকে বড় বাজেট বলা যাবে না। সার্বিকভাবে বাজেটে যেসব লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়, সেগুলো গ্রহণযোগ্য বলে মনে করি। কিন্তু এর বাস্তবায়ন নিয়ে সমস্যা রয়েছে। বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ ধরা হয়েছে। কিন্তু ৯ শতাংশ মূল্যস্ফীতি থেকে এত বড় ব্যবধান কমানোর কোনো নির্দেশনা নেই। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের রেপো রেট বাড়ানোর কথা বলা হয়। সেটা কোনো কার্যকর ভূমিকা পালন করেনি।
তিনি আরও বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। এটাকে সাধুবাদ জানাই। বর্তমানে পরিস্থিতিতে সরকার দারিদ্র্যসীমার নিচে জনসংখ্যার আনুপাতিক যে হার, সেটা স্বীকার না করলেও এটা সত্য, দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বেড়েছে। তাই সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা আছে। কিন্তু এ খাতের বরাদ্দ যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ যারা এখানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা, তারা হন না। আর যারা আসার কথা নয়, তারা চলে আসে। এ সমস্যাগুলো সমাধানে বাজেট বক্তব্যে কোনো বার্তা পাইনি। তাই এর সুফল পাওয়া নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।
এবি মির্জ্জা আজিজুল বলেন, বাজেটে রিজার্ভ কমে গেছে বলা হয়। আমদানি বেড়ে যাওয়া, রেমিট্যান্স ও রপ্তানি হ্রাস পাওয়ার কথাও বলা হয়। কিন্তু কীভাবে রিজার্ভ বাড়ানো হবে, তার সুনির্দিষ্ট কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তাই রিজার্ভ বাড়াতে হলে বিদেশে দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি করতে হবে। পাশাপাশি রপ্তানিতে নতুন নতুন পণ্যের বাজার ধরতে হবে।
তিনি আরও বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ ৬ শতাংশ বাড়ানোর কথা বলা হয়। এক বছরে কীভাবে এটা বাড়াবে তা বোধগম্য নয়। এছাড়া রাজস্ব আহরণের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, তা অর্জন হবে না। এডিপির লক্ষ্যমাত্রাও অর্জন সম্ভব নয়।
এবি মির্জ্জা আজিজুল বলেন, বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে যে সমস্যা, তার কোনো উল্লেখযোগ্য বক্তব্য দেখিনি বাজেটে। বিশেষ করে খেলাপি ঋণ আদায়ে কার্যকর কোনো পদক্ষেপের কথাই বলা হয়নি। যেটা বর্তমানে ব্যাংকিং খাতে সবচেয়ে বড় সমস্যা। অন্যদিকে ঘাটতি বাজেটের অর্থায়ন পূরণে ব্যাংক খাত থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিচ্ছে সরকার। সরকার যদি ব্যাংক খাত থেকে বেশি বেশি ঋণ নেয়, তাহলে বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধিতে প্রভাব পড়বে। বিনিয়োগ কম হবে। ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। এমনিতেই বেসরকারি খাতে প্রবৃদ্ধি কমে গেছে। এখনো পুঁজিবাজার ইনভেস্টমেন্ট ফাইন্যান্সিংয়ে ভূমিকা পালন করছে না। সেক্ষেত্রে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগের জন্য দরকার হচ্ছে ব্যাংক ঋণ। এছাড়া ব্যাংক খাত থেকে ঋণ বেশি নিলে মানি সাপ্লাই বেড়ে যায়। ঋণ নিয়ে যদি উৎপাদন না বাড়ে, তাহলে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়ে যাবে।
প্রস্তাবিত বাজেটে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অনেক রূপকল্পের কথা বলা হয়েছে। আছে নানা অর্জন আর প্রত্যাশার কথা। কিন্তু কোনো বিষয়েই সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নেই, এ মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।
তিনি বলেন, বাজেট নিয়ে যে আলোচনা করছি, তা নিয়ে পার্লামেন্টে খুব বেশি আলোচনা হবে না। কারণ বাজেট ধরতে গেলে ইতোমধ্যে পাশ হয়ে গেছে। দু-একটি জায়গায় পরিবর্তন আসলে আসতে পারে। বাজেট একটা মূল্যবান জিনিস। তাই এ বিষয়ে কথা বলছি। বাজেট নিয়ে এখন আর সাধারণ মানুষের আগ্রহ নেই। কারণ এখানে সাধারণ মানুষের জন্য কিছুই নেই।
তিনি বলেন, ‘ব্যক্তি করমুক্ত আয়ের সীমা যেটা সাড়ে ৩ লাখ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু দুই হাজার টাকা, যা মিনিমাম কর ধরা হয়েছে এটা কেন? রিটার্ন দিলেই দুই হাজার টাকা দিতে হবে। এটাকে আমার সাংঘর্ষিক মনে হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, এক বছরে বাজেট যে সব বাস্তবায়ন করবে তা নয়। তবে অগ্রাধিকার খাত এবং বর্তমানে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তার জন্য বাজেট দেওয়া উচিত ছিল। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স খাতে গুরুত্ব দেওয়া। এছাড়া দারিদ্র্য শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা, কৃষি ও শিল্পবান্ধব বাজেট করা দরকার ছিল। কিন্তু বাজেটে এসব বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা দেখলাম না। শুধু পেছনের গল্প শোনানো হয়েছে।
তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি ধরা হয়েছে ৬ শতাংশ। বর্তমানে রয়েছে ৯ শতাংশ, এটা ৬ শতাংশে আনা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক টাকা ছাপিয়ে সরকারকে ঋণ দিচ্ছে। এতে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। প্রস্তাবিত বাজেটেও ব্যাংক খাত থেকে বিপুল অঙ্কের ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। এতে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে রাখা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ব্যাংকিং খাত এমনিতেই তারল্য সংকটে ধুঁকছে। সরকার এ খাত থেকে ঋণ বাড়ালে বেসরকারি খাতে এর প্রভাব পড়বে। বেসরকারি খাতের প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। এতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সমালোচনা করে সাবেক এ গভর্নর বলেন, খেলাপি ঋণ আদায় হচ্ছে না, দুর্নীতি হচ্ছে এবং টাকা বাইরে চলে যাচ্ছে। এসব নিয়ে কাজ না করে এমডিরা বিদেশ যেতে পারবে না এ সার্কুলার নিয়ে ব্যস্ত।
অনেক চ্যালেঞ্জকে ভারসাম্য করেই সরকারকে এবারের বাজেট প্রণয়ন করতে হয়েছে বলে মনে করছেন আইপিডিসি ফিন্যান্সের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘অবশ্যই আমরা রাস্তাঘাটসহ দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন চাই, সেই সঙ্গে একটি সমতা ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের জন্য দেশে সুশাসন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, বিচারব্যবস্থার উন্নতিসহ একটি ব্যবসাসহায়ক পরিবেশও চাই।’ এছাড়া প্রাইভেট সেক্টর যেহেতু সব সময়ই রাজস্ব আহরণে সরকারকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করে থাকে তাই ব্যবসা-বাণিজ্য করতে কেউ যেন হয়রানির শিকার না হন এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো যাতে সরকার থেকে সহায়তা পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে।
অনুষ্ঠানে রাজস্ব আদায়ে ডিজিটালাইজেশনের গুরুত্ব, কার্যকরভাবে রাজস্ব আদায়ের কৌশল এবং ইনকাম ট্যাক্স আইনের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন স্নেহাশিষ বড়ুয়া। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন ব্র্যাক বিজনেস স্কুলের সিনিয়র লেকচারার তানিয়া আকতার।