Logo
Logo
×

সাহিত্য সাময়িকী

বই এক নতুন পৃথিবীর দরজা

Icon

অপূর্ব চৌধুরী

প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বই এক নতুন পৃথিবীর দরজা

বই মানে শব্দের বিপণি। কিন্তু বই কেবল শব্দের ভাঁড়ার ঘর নয়, বই একইসঙ্গে শব্দের সীমানা পেরিয়ে বাস্তবতার একটি দরজা। বলা যায়-একটি প্রবেশদ্বার। কিন্তু কিসের কপাট, কিসের প্রবেশপথ!

বই কেবল শব্দের সজ্জা নয়; বই আমাদের নিজস্ব পৃথিবীকে ছাপিয়ে অন্য একটি বাস্তবতার দরজা খুলে দেয়। প্রতিটি বই যেন একটি অজানা জগতের আমন্ত্রণ জানায়। সেই বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠা এক একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে আমাদের সামনে। বাস্তবে থেকেও অন্য আরেক বাস্তবতার ভেতরে ঢোকার পথ করে দেয় বই। বেশিরভাগ সময় আমাদের জীবন চেনাজানা রুটিনের বৃত্তে আবদ্ধ থাকে, বন্দি থাকে। পরিচিত পথ, পুনরাবৃত্ত কথোপকথন, একঘেয়ে অভ্যাস আমাদের দৈনন্দিন রুটিনের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। চাই বা না চাই, এমন রুটিনের বৃত্তে আমরা আটকে যাই। কিন্তু বই এ স্থবিরতাকে ভেঙে নতুন চিন্তার স্রোত বইয়ে দেয় আমাদের জীবনে, আমাদের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রায়। একটি ভালো বই আমাদের স্থান-কাল-পরিসীমার সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করতে সাহায্য করে। ‘ডন কিহোতে’ আমাদের নিয়ে যায় রোমাঞ্চকর মধ্যযুগে, ‘ওডিসি’ আমাদের সমুদ্রযাত্রার প্রতিটি ঢেউ অনুভব করায়, ‘গীতাঞ্জলি’ হৃদয়ের গভীরে পৌঁছে দেয় এক আধ্যাত্মিক প্রশান্তি। বই শুধু গল্প নয়, এটি আমাদের আত্মার ভ্রমণ।

২.

যখন আমরা বই পড়ি, তখন আমরা কেবল পাঠক নই, বইয়ের বর্ণনার ভেতরে থাকা জগতের অংশ হয়ে যাই। পড়তে পড়তে শেক্সপিয়রের ‘ম্যাকবেথ’-এর সঙ্গে ক্ষমতার মোহ বুঝতে পারি, রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছ’-এর ছোটগল্পগুলোতে জীবন এবং সম্পর্কের গভীরতা খুঁজে পাই, পড়তে পড়তে দস্তয়েভস্কির ‘নোটস ফ্রম আন্ডারগ্রাউন্ড’-এ বিভিন্ন চরিত্রের সঙ্গে অন্তর্জগতের সংগ্রামে হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকে। পাঠক মাত্রই জানেন, কোনো ভালো উপন্যাস কিংবা যে কোনো ভালো লেখা পড়া মানে লেখার চরিত্রদের সঙ্গে হাঁটা, ঘটনার সঙ্গে উঠাবসা, তাদের হাসি-কান্না নিজের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া। এ ভাগাভাগি নিজেদের তাদের ভেতর দেখার সুযোগ করে দেয়। পড়তে পড়তে গল্পের বাঁকে বাঁকে বিভিন্ন চরিত্রের ঘটনায় লুকিয়ে থাকা প্রশ্নগুলোর প্রতিনিয়ত উত্তর খুঁজে মন। ভালো একটি বইয়ের শব্দগুলো, লেখকের কলমে তৈরি প্রতিটি বাক্য এমন করে পাঠকের আত্মপরিচয়কে প্রশ্নবিদ্ধ করে, চিন্তার দিগন্তকে প্রসারিত করে যে-ভাবনার দরোজায় টোকা না পড়ে উপায় থাকে না।

৩.

বইয়ের থাকে এক ধরনের চিন্তা রূপান্তরকারী চিন্তা বা শক্তি। বই আমাদের শুধু তথ্য দেয় না, বরং আমাদের বদলে দেয়। আমাদের চিন্তাকে আরেকটি চিন্তা দিয়ে পালটে দেয়। একটি শক্তিশালী উপন্যাস আমাদের সহমর্মিতা বাড়াতে পারে; একটি গভীর দার্শনিক বই আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পালটে দিতে পারে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘গোরা’ কেবল উপন্যাস নয়, বরং জাতীয়তাবাদ ও আত্মপরিচয়ের গভীর অনুসন্ধানের পথ দেখায় আমাদের। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ জীবন সংগ্রামের চিত্র এঁকে আমাদের আবেগকে নাড়া দেয়। জর্জ অরওয়েলের ‘১৯৮৪’ আমাদের সমাজ এবং রাজনীতির অন্ধকার দিকগুলো নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে।

৪.

আজকের ডিজিটাল যুগে যখন সংক্ষিপ্ত এবং দ্রুত তথ্যের দুনিয়ায় আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি ক্রমশ, তখন বই পড়া যেন এক ধরনের প্রতিবাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দ্রুতগতির এ তথ্যের যুগে বই আমাদের গভীর মনোযোগ গড়ে তোলে। অতি সরলীকরণের যুগে বই জটিল চিন্তাকেও কখনো কখনো উপলব্ধি করায়। যখন আমাদের চারপাশে খবরের শিরোনাম আর সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টগুলো আমাদের মনকে বিভ্রান্ত করে, তখন ভালো একটি বই আমাদের একাগ্রতা ফিরিয়ে দেয়, আমাদের মাঝে ধৈর্য তৈরি করে। বইয়ের মধ্যে আঁকা বিভিন্ন চরিত্র আমাদের যান্ত্রিকতার যুগে সংবেদনশীলতা শেখায়।

৫.

বইয়ের মাধ্যমে লিপিবদ্ধ এবং জেনারেশন থেকে জেনারেশনে বইয়ের এ ধারায় প্রাপ্ত মহান সাহিত্যগুলো কখনোই স্থবির থাকে না; বরং এটি বিভিন্ন সময়ে নতুন নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ করে দেয় আমাদের। অ্যারিস্টটলের ‘পোয়েটিকস’ থেকে শুরু করে আধুনিক সাহিত্যের ব্যাখ্যা আমাদের সাহিত্য এবং জীবনকে বোঝার পরিধিকে বাড়িয়ে তুলেছে আরও বেশি। পোস্টমডার্নিজম বা ফেমিনিস্ট ক্রিটিসিজমের মতো নতুন সাহিত্য বিশ্লেষণ আমাদের নতুন চিন্তার খোরাক দেয়। রবীন্দ্রনাথ থেকে জীবনানন্দ দাশ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি ধারা বিভিন্ন সময়ে নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হয়েছে এ বইয়ের মাধ্যমেই। যখন আমরা সাহিত্য বিশ্লেষণ করি, তখন আমরা শুধু বইয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকি না। আমরা সময়, সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং দর্শনের এক বৃহৎ সংলাপে অংশ নিই। বই তখন হয়ে ওঠে কালের এক মহামিলনমেলা।

৬.

পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের একটি সাধারণ অভ্যাস ছিল যে-তারা সবাই ভালো পাঠক ছিলেন। বইয়ের পাঠক ছিলেন। সক্রেটিস, প্লেটো, শেক্সপিয়ার, মার্ক টোয়েন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সবাই পড়ার মাধ্যমে নিজেদের বিকশিত করেছেন, আমাদের বিকশিত হতে সৃষ্টিও করে গেছেন। বই কেবল জ্ঞানার্জনের মাধ্যম নয়, বরং একটি সূক্ষ্ম, গভীর এবং মানবিক জীবনদৃষ্টি গড়ে তোলে আমাদের চিন্তায়, মানসে, চরিত্রে এবং অনুভবে। আজকের বিশ্ব যেখানে দ্রুততা ও ভাসা-ভাসা চিন্তাকে গুরুত্ব দেয়, সেখানে বই আমাদের চিন্তার গভীরতা ও দৃষ্টিভঙ্গির স্পষ্টতা দেয়।

বই আমাদের জীবনে কেবল অবসরের সঙ্গী নয়; বই প্রতি মুহূর্তে নতুন দরজা একটি খুলে দেয় আমাদের সামনে। যে কোনো সংকটে, যে কোনো প্রশ্নে, একটি ভালো বই আমাদের নতুন আলো দেখায়।

একটি ভালো বই সম্ভাবনার জানালা খুলে দেয়, মনে আশা জাগায়। প্রতিটি পৃষ্ঠা যেন এক নতুন দিগন্ত খুলে দেয় আমাদের সামনে। তাই আসুন আমরা পড়ার অভ্যাস ধরে রাখি। প্রতিটি বইয়ের মধ্য দিয়ে নিজেদের খুঁজে নিই, নতুন পৃথিবী আবিষ্কার করি। কারণ প্রতিটি ভালো বই কেবল তথ্য নয়, বরং এ এক নতুন পৃথিবীর দরজা।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম