আধুনিকতা এবং আধুনিকতাবাদ
মুহম্মদ নওফল জমির
প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
Modernity শব্দটির উৎপত্তি Latin শব্দ Modernus থেকে, যার অর্থ ‘আজকের সঙ্গে সম্পর্কিত কোনো বিষয় বা বস্তু’। Modernity বা আধুনিকতা শাব্দিকভাবে পুরোনো থেকে ব্যতিক্রমী কিছু বোঝায়। আধুনিক বা Modern শব্দটি সনাতন বা ট্র্যাডিশনালের বিপরীত শব্দ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। আধুনিক সমাজ বা শিল্পনির্ভর (Industrial) সমাজের আরেক নাম আধুনিকতা। আধুনিকতা একটি কাল বা অবস্থা (State of Being)। কোনো বিষয়ে কালের সংজ্ঞা বা পরিধি নির্ভর করবে সে বিষয়ের দৃষ্টিকোণের ওপর ভিত্তি করে। ইতিহাস, দর্শন, অর্থনীতি, রাজনীতি, প্রযুক্তি ও আইন-এ বিষয়গুলোর পরিপ্রেক্ষিতে কালের সংজ্ঞা এবং পরিধির ভিন্ন দৃষ্টিকোণ তো আছেই, উপরন্তু একেকটি বিষয়ে কাল সম্পর্কে একাধিক মতবাদ আছে। এর কারণ, এসব বিষয় কালকে তাদের নিজস্ব প্রগতি, বর্ধন, অর্জন বা সাফল্য প্রভৃতি মাত্রার ওপর ভিত্তি করে নির্ণয় করে। আধুনিককালের দর্শন, রাজনীতি বা ইতিহাসে যাওয়ার আগে আমরা সাধারণ অর্থে আধুনিককাল বলতে কী বোঝায়, তার একটি কার্যকর ধারণা তৈরি করি। স্বাভাবিকভাবেই আমাদের প্রথম চিন্তা আসবে প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা বা সাফল্য। আজকের দিনে যোগাযোগের মাধ্যম টেলিফোন, মোবাইল ফোন, কম্পিউটার, ইন্টারনেট এবং যাতায়াতের মাধ্যম প্লেন, গাড়ি, ট্রেন, উন্নত রাস্তাঘাট প্রভৃতি দেখে যে-কেউ বুঝতে পারেন, এ ব্যাপারগুলো আধুনিক। অঞ্চলভেদে ৫-১০ পুরুষ আগে মানুষের জীবনধারায় এসব প্রযুক্তির কথা কল্পনাও করা যেত না।
আগেকার দিনে সূর্যের অবস্থান দিয়ে সময় নির্ণয় করা হতো। তাতে স্থানীয় সময় নির্ণয় করা যেত। কিন্তু দূরের অঞ্চলের সময় জানা সম্ভব ছিল না। সম্ভব হতো না দূরবর্তী স্থানের সময়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কিছু করা। যাতায়াত ও যোগাযোগ স্থানীয়ভাবে সীমাবদ্ধ থাকায় পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের সময়ের সামঞ্জস্য প্রয়োজন ছিল না। ৬০ সেকেন্ডের কাঁটা সংবলিত মেকানিক্যাল বা যান্ত্রিক ঘড়ি প্রথম নির্মিত হয় ১৫৭৭ সালে। International System of Units (SI) ২০ মে ১৮৭৫ সালে প্যারিসে মিটার কনভেনশনের মাধ্যমে ১৭টি দেশে centimetre-gram-seconds (C‡S) অর্থাৎ আন্তর্জাতিকভাবে সেকেন্ডকে সময় পরিমাপের ইউনিট বা মাত্রা হিসাবে গ্রহণ করা হয়। এর আগে একেক রকম মানদণ্ডে ওজন, সময় ও দূরত্ব মাপা হতো। ১৮৮৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন পরিমাপের মান প্রচলিত হয়। দিনকে ২৪ ঘণ্টা, ঘণ্টাকে ৬০ মিনিট এবং মিনিটকে ৬০ সেকেন্ডে ভাগ করার কারণে সময়কে অনেক নিখুঁতভাবে পরিমাপ করা যায়। এর ফলে সময় পরিমাপের একটি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বা স্ট্যান্ডার্ড তৈরি হয়। সময়কে বিশ্বায়ন করা সম্ভব হয়।
১৫-১৬ শতকে সমুদ্রপথে বাণিজ্য এবং উপনিবেশ বিস্তারের জন্য মানচিত্র তৈরির প্রয়োজন অনুভূত হয়। পৃথিবীকে অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশে বিভক্ত করে সঠিক অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়। যোগাযোগ ও যাতায়াতের উন্নতি ঘটে। রেলগাড়ির আবির্ভাব হলে রেলগাড়ির সময়সূচি সঠিকভাবে বুঝতে দূরের স্থানের সময়ের সঙ্গে স্থানীয় সময়ের পার্থক্য নির্ণয় করার প্রয়োজন অনুভূত হয়। মানুষের ইতিহাসে সময় ও দূরত্ব-এ দুটি বিষয়ের ধারণায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে।
মানুষের জীবনধারায় ধীরে ধীরে নতুন ধরনের প্রতিষ্ঠান ও প্রযুক্তি জায়গা করে নেয়। মানুষের জীবনধারার আকাশ-পাতাল পার্থক্যের সৃষ্টি হয়। মাত্র ৩-৪ পুরুষের সময় পার্থক্যে মানুষ হাজার হাজার মাইল দূরত্ব অল্প সময়ে পেরোতে সক্ষম হয়। মানুষের জীবনে প্রযুক্তির প্রভাব এবং বিকাশকে সাধারণভাবে আধুনিক জীবন বলে বর্ণনা করা যায়। তৈলচিত্র, গানবাজনা, বই, নাটক-এসব বিষয় আধুনিকতার আগে কেবল ধর্মীয় চিন্তা-চেতনা দ্বারা পরিবেষ্টিত ছিল। শত শত বছরের বিজ্ঞানের প্রসারে এবং আলোকিত যুগের (Age of Enlightenment) দর্শনের প্রভাবে নতুন ধরনের সংস্কৃতি আগের ধর্মভিত্তিক সংস্কৃতিকে প্রতিস্থাপন করে। শিল্প, সিনেমা, গান, বাদ্য, সাহিত্য- সবকিছুতে আধুনিকতার ছাপ পড়ে বিংশ শতাব্দীতে। সাংস্কৃতিকভাবে এবং মানুষের জীবনধারায় প্রযুক্তির প্রভাবের আঙ্গিকে আধুনিকতার চরম বিকাশ ঘটে বিংশ শতাব্দীতে। বিংশ শতাব্দী আধুনিকতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ। সুপারম্যান, ব্যাটম্যান, স্পাইডারম্যান, অ্যাভেঞ্জার্স, নাইটরাইডার, ম্যাকগাইভার, দ্য এ টিম, থান্ডার ক্যাটস, সিম্পসন, ফ্রেন্ডস, হ্যারি পটার এবং হাজারো ভিন্ন ধরনের কাল্পনিক বিষয় আমাদের সংস্কৃতির অংশ হয়ে যায়। আশির দশকে বাংলাদেশে আমরা টিভি, রেডিও এবং টিঅ্যান্ডটির ল্যান্ড ফোন দেখি। আজ ৩৫টির অধিক টিভি চ্যানেল, ইন্টারনেট, সুপার স্মার্ট মোবাইল ফোন, রোবটিক্স, ড্রোন এবং আরও কত কিছু। শরৎচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল, সমরেশ, শীর্ষেন্দু, হুমায়ূন আহমেদ, সেবা প্রকাশনী ছাড়াও আমরা যা কিছু কম্পিউটার, স্মার্টফোন, টিভি, পত্রিকা, বিজ্ঞাপন, ম্যাগাজিন এবং অন্যান্য প্রচারমাধ্যমে দেখি- এসব কিছু মিলেই আমাদের সংস্কৃতি।
আধুনিককালের পর একবিংশ শতাব্দীতে এসেছে উত্তরাধুনিকতা (Post-modernism)। সংশয়বাদ উত্তরাধুনিকতার প্রধান বৈশিষ্ট্য। আগের সব ধারণাকে সন্দেহের চোখে দেখা হলো উত্তরাধুনিকতা। অনেকে দাবি করেন, শিল্প ও দর্শনে উত্তরাধুনিকতা নতুন কোনো গঠনমূলক প্রবৃদ্ধি বা অগ্রগতি সাধন করে না, কেবলই একটি সন্দেহের নেতিবাচক ধারার অবতারণা করে। উত্তরাধুনিকতার পর অবতারণা হয়েছে remodernism, performatism ges meta-modernism নামক নতুন ধারাগুলো। বর্তমান বাস্তবতার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো hyper-reality বা কাল্পনিক-বাস্তবতা। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ-এসব আমাদের সারাক্ষণ একের পর এক নতুন নতুন তথ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিজ্ঞাপন, নিউজ, নাটক ও সিনেমা-পরিবেষ্টিত জীবনে কোনটা সত্য, এটা বোঝা দুষ্কর। এখন ১৪টি চ্যানেল আছে, একসঙ্গে চলছে, অনলাইনে আছে-on-demand- তথ্য এবং ভিডিও, যা-ই যখন দেখতে চাইবেন, তখনই দেখতে পাবেন। গান, নাটক, সিনেমা দেখতে আর অপেক্ষা করতে লাগে না। সব কাল্পনিক তথ্য, আমাদের যা ভালো লাগে দেখতে, আমরা কেবল সেগুলোই দেখি। এ যুগ ইন্টারনেটে targeted বিজ্ঞাপন এবং fake news-এর জমানা। ৫০ বছর আগে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরকে যতটা নির্ভরযোগ্য বিবেচনা করা হতো, এখন মানুষ জেনেশুনেই সংবাদ পড়েন যে, যা পড়ছেন তার খানিকটা বা অনেকটা সত্য না হওয়ার আশঙ্কা আছে। বিবিসির মতো বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয় সংবাদমাধ্যম হলুদ সাংবাদিকতায় সিদ্ধহস্ত। মিয়ানমারে ২০১৫ সালে সু চির নির্বাচন তিন দিন বিশ্বব্যাপী প্রচার করেছে বিবিসি; কিন্তু একটিবারের জন্য বলেনি যে, রোহিঙ্গা মুসলমানদের কোনো ভোটাধিকার এ নির্বাচনে ছিল না। এটা কেবল একটিমাত্র উদাহরণ, বিবিসির দুর্বৃত্ত সাংবাদিকতার বহু উদাহরণ আছে। ব্রিটেনের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রী টিভি ভাষণে বেমালুম একের পর এক মিথ্যা তথ্য দিতে থাকেন এবং মিথ্যা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। পৃথিবীর সব সংবাদমাধ্যমের ৯৫ শতাংশের মালিক মাত্র ৬টি করপোরেশন। এক কথায় hyper-reality সম্পন্ন প্রাক-আধুনিককালে আপনি যা কিছু ফ্রি বিজ্ঞাপন বা মিডিয়ায় দেখছেন, এর ৯ শতাংশের পেছনে একটি উদ্দেশ্য বা এজেন্ডা আছে, অর্থাৎ এসব সংবাদ নির্ভরযোগ্য নয়।
প্রাণী হিসাবে মানুষ জাতির মৌলিক কোনো উন্নতি হয়নি। বস্তুগত উন্নতির ব্যস্ততায় বিভোর হওয়ার সব উপাদান সীমাহীনভাবে বৃদ্ধি পেলেও ‘জন্মিলে মরিতে হবে’-এ প্রাচীন সত্যে আমরা আবদ্ধ আছি। মৃত্যুর পর আমার কর্মকাণ্ডের কৈফিয়ত আমাকেই দিতে হবে। কোনো specialised রাজনীতিবিদ, দার্শনিক বা আইনজীবী আমার তরফে উকিল থাকবেন না। কাজেই আধুনিকতাবাদীদের ওপর বিশ্বাস বা আস্থা বৈজ্ঞানিক বিষয়েই আবদ্ধ থাকা একান্তই আবশ্যক। জীবনচলার ও জীবনধারণের নিয়মনীতি, রীতিনীতি এবং নৈতিকতাবিষয়ক কোনো বিষয়ই আধুনিক দর্শনের ওপর বিশ্বাস বা আস্থা স্থাপন করা আদর্শগতভাবে অযৌক্তিক এবং আত্মহত্যার শামিল।
আলোকিত যুগের বিভিন্ন দার্শনিকের মাঝে দর্শনের বিস্তর ব্যবধানেও একটি সার্বজনীন ধারা লক্ষ করা যায়। জন গ্রে দাবি করেন যে, সামগ্রিকভাবে আলোকিত যুগের সব দার্শনিক একটি মৌলিক চেতনার ভিত্তিতে কাজ করেছেন। এ কারণে তাদের সবার কাজেই একটি চিন্তার ঐক্য বিদ্যমান। তার মতে, আলোকিত যুগের মূল চেতনার ভিত্তি হলো সব রকমের স্থানীয়, গতানুগতিক এবং ঐতিহ্যগত নৈতিকতা ও ধর্মীয় বিশ্বাসসংক্রান্ত চিন্তা-চেতনার উৎপাটন। যুক্তিভিত্তিক ও সমালোচনামূলক নৈতিকতার দ্বারা পূর্ববর্তী সব নৈতিকতাকে প্রতিস্থাপন করা এবং যুক্তিভিত্তিক ও সমালোচনামূলক নৈতিকতাকে সার্বজনীন আকারে প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল আলোকিত যুগের দার্শনিকদের মূল লক্ষ্য।
আমি আধুনিকতার সীমা নির্ধারণ করব আলোকিত যুগে সনাতন ধর্ম থেকে বেরিয়ে আসার পর থেকে আজ পর্যন্ত সব সময়কালকে। উত্তরাধুনিকতা থেকে মেটা-আধুনিকতা ও hyper-reality এবং ভবিষ্যতেও আরও নতুন নতুন যা কিছু আসতে পারে, সেসব ধারণাকেও আমি আধুনিকতার সংজ্ঞায় ফেলব। এর কারণ, সনাতন ধর্ম থেকে পরিবর্তিত হয়ে যা কিছুই আবির্ভূত হচ্ছে, তাই আধুনিকতার অংশ। আধুনিকতার পণ্ডিতরা নতুন নতুন ধারণার ওপর ভিত্তি করে নতুন নতুন নামকরণ করতে পারেন; কিন্তু বস্তবতা হচ্ছে এরা সবাই সতীর্থ। একই টেবিলে বসে টেবিল চাপড়িয়ে তারা তর্কবিতর্ক করবেন। কিন্তু তাদের মাঝে একজন মৌলভি, রাবাই বা পুরোহিতকে বসিয়ে দিন, তারা সবাই এদের চিন্তাধারার জোরালো বিরোধিতা করবেন। সনাতন ধর্মের ব্যাপারে রয়েছে আধুনিকতার সব ধারার কিছু মৌলিক পার্থক্য। এ মৌলিক পার্থক্য আলোকিত যুগের দর্শনের ধারাবাহিকতায় আজও একইভাবে বিদ্যমান। কাজেই দর্শন ও শিল্পে সনাতন ধর্ম ছাড়া নতুন সব ধারাই আমার দৃষ্টিতে আধুনিকতা।
আধুনিকতার মৌলিক সংজ্ঞা সময় বা কালকেন্দ্রিক এবং আধুনিকতাবাদের মূল চিন্তা আধুনিককালের চিন্তাধারাকেন্দ্রিক। আধুনিকতাবাদ একটি মতাদর্শ, একটি আদর্শ ও চেতনা। আধুনিক বিজ্ঞান কেন আধুনিক? সর্বকালে বিজ্ঞান কি আধুনিক ছিল না? সময় বা কালের সংজ্ঞায় সর্বকালেই বিজ্ঞান আধুনিক ছিল। সাধারণ চিন্তায় সেটাই বোঝায়। কিন্তু আধুনিকতাবাদ বা আধুনিক দর্শনের সংজ্ঞায় সর্বকালের বিজ্ঞান সেকালেও আধুনিক ছিল না, অর্থাৎ ১২০০ সালে বসে ১২০০ সালের বিজ্ঞানকেও আধুনিক বলা যাবে না। আধুনিকতাবাদ বা দর্শনশাস্ত্রের দ্বারা সংজ্ঞায়িত ‘আধুনিকতা’ বিজ্ঞানকে নতুন কিছু চিন্তা-চেতনা, ধারণা বা ধারায় আবদ্ধ করে। এসব চিন্তা-চেতনা বিজ্ঞানকে ‘আধুনিক বিজ্ঞান’ লেবেল দেয়। আধুনিক বিজ্ঞান তাই একটি মতাদর্শ বা দর্শনশাস্ত্রের বিষয়, সময় বা কালের বিষয় নয়। অর্থাৎ আধুনিক বিজ্ঞানকে আধুনিক হতে একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়। সে প্রক্রিয়া অনুসরণ করা না হলে একে আধুনিক বলা যাবে না। হোমিওপ্যাথি বা কবিরাজি শাস্ত্রকে আধুনিক বলা যাবে না, যদিও এর চর্চা ও সুফল আধুনিককালেও পাওয়া যাচ্ছে। এর কারণ কী? কারণ, একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় এবং সুনির্দিষ্ট চিন্তাধারা অনুসরণ করে এসব শাস্ত্র গড়ে ওঠেনি। তেমনই দোয়া-খায়েরের মাধ্যমে রোগমুক্তি কামনা করা আধুনিক নয়। তবে কি দোয়ায় রোগমুক্তি হয় না? আধুনিক বিজ্ঞানের বক্তব্য হলো, দোয়ায় রোগমুক্তি হলেও হতে পারে; কিন্তু গ্যারান্টি নেই। অর্থাৎ একই প্রক্রিয়ায় প্রতিবার দোয়ায় যে কাজ হবে, তা প্রমাণ করা সম্ভব নয় বলে তাকে আধুনিক বলা যাবে না। কাজেই আধুনিকতাকে একটি চিন্তাধারা হিসাবে আমরা সাধারণভাবে ব্যবহার করি, যার সঙ্গে সময়ের সম্পর্ক নিছক শাব্দিক। আধুনিকতা বলতে বোঝায় নতুন কোনো চিন্তাধারাকে। এ অর্থে আধুনিক বিজ্ঞান হলো সেই পদ্ধতি, যার মাধ্যমে কোনো কার্যকারণ সম্পর্ক প্রমাণ করা যায়। তাই আধুনিকতা ও আধুনিকতাবাদ শব্দ দুটিকে আমরা এক ও অভিন্ন মতাদর্শ এবং চিন্তাধারা হিসাবে ব্যবহার করব।
জার্মান দার্শনিক হেগেলের মতে, আগামীকাল গতকালের থেকে আধুনিক হবে। আর আধুনিক হওয়া মানেই মানবসভ্যতা আগের চেয়ে উন্নত হচ্ছে। আধুনিকতাকে আমরা আধুনিকতাবাদ অর্থে ব্যবহার করব। বাংলায় আধুনিক গানের একটি যেমন অর্থ আছে, অর্থাৎ আপনি যখনই শোনেন না কেন, এ ধরনের গানগুলোর আবেদন সর্বকালের জন্যই আধুনিক থাকবে বা সব বর্তমানের আবেগের সঙ্গে খাপ খাবে, তেমনই মতাদর্শ হিসাবে আধুনিকতাবাদ কিছু মতবাদ, তত্ত্ব ও ধারণাকে বোঝায়। কার্ল স্মিটের (Carl Schmitt) আলোচনা অনুযায়ী আধুনিকতার কেন্দ্রীয় ধারণা (Central Domain) বা প্যারাডাইমকে সঠিকভাবে চিহ্নিত এবং বিশ্লেষণ করতে পারলে আমরা আধুনিকতাকে সঠিকভাবে বুঝতে পারব। তাই আধুনিকতার হালচাল আধুনিক প্রযুক্তির হালহকিকত নয়, বরং আধুনিক চিন্তা-চেতনা মতাদর্শ এবং ভাবাদর্শের হালহকিকত। যেসব চিন্তাধারা ও আদর্শের কারণে আমাদের জীবনধারার আমূল পরিবর্তন, বর্তমান এবং ঐতিহাসিক ঘটনাবলির সাপেক্ষে সেসব আদর্শ ও চিন্তাধারার বিশ্লেষণ।
ম্যাক্স ওয়েবার (১৮৬৪-১৯২০) নামক জার্মান দার্শনিকের মতে, আধুনিকতার শুরু একটি মনোভাব বা ধারণা দিয়ে। সৃষ্টিকর্তা থাকুক বা না থাকুক, বিশ্বজগতের ১০০ ভাগ বস্তু কিছু নিয়মে চলে। এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে সৃষ্টিকর্তার প্রয়োজন নেই। তাই মানুষের পক্ষে সৃষ্টির সব বস্তুকেই নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। অর্থাৎ বস্তুজগতের সবকিছুর ওপর মানুষের একচ্ছত্র আধিপত্য রয়েছে। মানুষ এ বস্তুজগৎকে যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে ব্যবহার করতে পারে। অর্থাৎ মানুষের প্রধান কাজ বস্তুজগৎকে তার নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারা। দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে সনাতন চিন্তাধারা আলোচনা করে ‘বাস্তবতা কী হওয়া উচিত?’ (What reality ought to be?) অথবা একজন মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে ‘আমার কী করা উচিত?’। অন্যদিকে নতুন বা আধুনিক চিন্তাধারা প্রশ্ন করে ‘বাস্তবতা আসলে কী?’ (what reality is?) অর্থাৎ ‘আমি বাস্তবে কী করতে পারি?’ এ দুই ধারার চিন্তায় পার্থক্য হলো প্রথম ধারা ‘উচিত’ বিষয়ে প্রাধান্য দেয়। ‘উচিত’ নির্ণয় করতে হলে উচিত সম্পর্কে একটি পূর্বধারণা প্রয়োজন। যেমন, আমার দৈনন্দিন জীবন কেমন হওয়া উচিত প্রশ্ন এলে ‘ভালো এবং মন্দ’ কাজ এ বিষয়ের অবতারণা ঘটে। ভালো ও মন্দ সম্পর্কে ধারণাগুলো হলো পূর্বধারণা। কিন্তু দ্বিতীয় ধারা প্রশ্ন করে, ‘আমি দৈনন্দিন জীবনে কী করতে পারি?’ এ প্রশ্নটি কেবলই বাস্তবতানির্ভর প্রশ্ন, এক্ষেত্রে কাজের ‘মান’ ভালো বা মন্দ কোনো পূর্বধারণার ওপর নির্ভর করে না। নির্ভর করে যুক্তি ও বাস্তবতার ওপর। দর্শনের ভাষায় একে বলা হয় যৌক্তিক চিন্তা প্রক্রিয়া (rational behaviour)। ওয়েবারের মতে, সনাতন থেকে আধুনিকতায় রূপান্তরিত হতে সমাজকে যুক্তিভিত্তিক চিন্তাধারায় (Rationalisation) উন্নীত হতে হয়েছে। Rationalisation-কে ওয়েবার তিনটি বৈশিষ্ট্য দিয়ে সংজ্ঞায়িত করেন : ১. গণনাযোগ্যতা (Calculability)- অঙ্কের মাধ্যমে যাকে হিসাব করা যায়, ২. নিয়মতান্ত্রিক ব্যবহার বা আচার (Methodical Behaviour) এবং ৩. আত্মপ্রতিফলন (Reflexivity) অর্থাৎ, নিজেকে (সমাজ) প্রতিফলনের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত উন্নতির চেষ্টা প্রথম ও দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য ব্যবহার করে। ম্যাক্স ওয়েবারের বিশ্লেষণ অনুযায়ী সনাতন সমাজব্যবস্থার সঙ্গে আধুনিক সমাজব্যবস্থার বড় পার্থক্যগুলো হলো আধুনিক সমাজে ক্ষমতা কীভাবে কাজ করে, আমলাতন্ত্রের উৎপত্তি এবং মানুষের সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস।
আলোকিত যুগের (Age of Enlightenment) দর্শন হলো মানুষ সবকিছু যুক্তি ও বিজ্ঞানের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করতে পারে। জ্ঞানবিজ্ঞানের মাধ্যমেই সব কুসংস্কার, ধর্মবিশ্বাস এবং রাজনৈতিক যথেচ্ছাচার থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। যেখানে সনাতন বা ধর্মভিত্তিক চিন্তাধারা চিন্তা করতে বাধ্য করে ‘কী করা উচিত?’ সেখানে Rationalisation চিন্তা করতে শেখায় ‘বাস্তবতা কী?’, কী করতে হবে বা কী করা উচিত-সেই প্রশ্নের আলোচনা Rationalisation ছেড়ে দেয় আপনার হাতে। আপনার ইচ্ছা বা মূল্যবোধের প্রশ্ন নিয়ে Rationalisation চিন্তিত নয়। কিন্তু এর একটি ব্যতিক্রম আছে- ধর্মীয় মূল্যবোধ বা সনাতন মূল্যবোধ, যা কিছুই ধর্মের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত, তাকেই আধুনিক দর্শন অস্বীকার করে। যদিও এমনটি হওয়ার প্রয়োজন ছিল না বা প্রয়োজন নেই, কারণ Rationalisation যদি কেবলই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা হয়, তবে কোনো ধর্মই বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে না; কিন্তু আধুনিক দর্শনে এ এক বিষয়ে পক্ষপাতিত্ব আছে। এ পক্ষপাতিত্ব জন্মলগ্ন থেকে এবং এ বিষয়ে গভীর আলোচনা করলে কয়েক বলিয়মের বই লেখা যাবে। কাজেই এতটুকুই আমাদের জানা প্রয়োজন যে, যেহেতু সনাতন বা ধর্মীয় চিন্তা-চেতনার সঙ্গে আধুনিকতার যৌক্তিক চিন্তাধারার প্রতিযোগিতা জন্মলগ্ন থেকে, সেহেতু আধুনিকতা নিজেকে সংজ্ঞায়িত করে সনাতন বা ধর্মভিত্তিক সব মূল্যবোধকে অস্বীকার করার মাধ্যমে। এর মাধ্যমে আধুনিকতা নিজের স্বতন্ত্র পরিচিতি সৃষ্টি করার চেষ্টা করে।