আমাদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা সকালে ঘুম থেকে উঠেই দৈনিক পত্রিকা খুলে বসেন। যাদের পড়ার অভ্যাস আছে তাদের পত্রিকার প্রবন্ধ কিংবা কলাম পাঠে সাহিত্যের আমেজ না পেলে দস্তুরমতো চলে না।
কারণ, প্রত্যেক পাঠকমাত্রই লেখকের নিবন্ধ পড়ে বিমোহিত হওয়ার একটা বাসনা রাখেন। এটা পাঠকের এক ধরনের অধিকারও। আর যখন কোনো লেখার ভাষা হয় চমৎকার, তথ্যে থাকে প্রাসঙ্গিকতা, আমরা রুদ্ধশ্বাসে সে লেখা পড়ে ফেলি। বিশেষ করে দৈনিক পত্রিকার উপসম্পাদকীয় কিংবা সাহিত্য খুব প্রয়োজনীয় একটি পাতা। সেটা ব্যক্তিগত পাওয়া না পাওয়ার জবেদা খাতা নয়। এখানে সমসাময়িক প্রসঙ্গের সঙ্গে পাঠকের একটা যোগসাজশ তৈরি করে দেয়।
ইতিহাসের সঙ্গে শক্ত সম্বন্ধ না থাকলে সে কাজটা করা অসম্ভব। সাইফুর রহমান ইতিহাসের সঙ্গে যোগাযোগের রাস্তাটা মসৃণ রেখেছেন। এ কারণেই তার লেখা নিবন্ধ পড়ে পাঠককে ঠকতে হয় না। একটা নিজস্ব ভঙ্গিতে তিনি লিখেন। সেটা অনেকটা গল্প বলার মতো।
পাঠক সেই গল্পে বিভোর হন এবং বিভোরতার এক পর্যায়ে বুঝতে পারেন সমসাময়িক ঘটনাটি ইতিহাসের কোন পথ ধরে এগোচ্ছে। এতে পাঠক ঘটনা সম্পর্কে তার একটা নিজের ভাবনা তৈরি করে ফেলতে পারেন। আর সে ভাবনা তৈরির পথই একজন পাঠকের একান্ত প্রাপ্তি। সাইফুর রহমানের লেখা সমকালীন বিশ্বের ঘটনাপ্রবাহকে চিন্তার জগতে এনে ফেলতে সহায়ক ভূমিকা রাখে বলে আমি মনে করি।
প্রবন্ধ কিংবা কলাম লেখাটা কতটুকু শক্তিশালী এ নিয়ে বিতর্ক নেই। শুধু সাংবাদিক হলেই যে জবরদস্ত কিছু লিখতে পারবেন এমন নয়। একটা উদাহরণ দিই। যারা বই পড়তে ভালোবাসেন তাদের কাছে টাইম মেশিন, ওয়ার অফ দ্য ওয়ার্ল্ডস এই উপন্যাসগুলো প্রিয়।
এ সবের লেখক ছিলেন কালজয়ী ব্রিটিশ সাহিত্যিক এইচ জি ওয়েলস। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি লন্ডনের পত্রপত্রিকায় জার্মানির মিলিটারি শক্তির বিপক্ষে কিছু প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তিনি মনে করতেন যুদ্ধের মাধ্যমে জার্মানিকে পরাজিত করা ছাড়া মিত্রশক্তির হাতে অন্য পথ খোলা নেই। এ লেখাগুলো সে সময়ের উপযোগী ছিল।
পাঠকপ্রিয়তাও পেয়েছিল। সেগুলো এক সময় বই আকারে প্রকাশিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে রাজনীতিবিদদের দারুণ উদ্বুদ্ধ করেছিল তার সেসব লেখা।
ইংরেজিতে ‘ক্যাচফ্রেজ’ বলে একটা কথা আছে। এর অর্থ এমন কিছু চালু শব্দ যেগুলো বারবার ব্যবহার হতে হতে এক সময় ট্রেডমার্কের পর্যায়ে চলে যায়। এইচ জি ওয়েলস সে সময় রাজনীতবিদদের বলেছিলেন জার্মানির শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে। তিনি বলেছিলেন এমন একটা যুদ্ধ প্রয়োজন যেটা সব যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটাবে, ‘দ্য ওয়ার টু অ্যান্ড দ্য ওয়ার’।
সে সময় এ কথাটা বিলেতে ক্যাচফ্রেজের মতো হয়ে গিয়েছিল। সাধারণ জনগণ থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদরা পর্যন্ত ব্যবহার করতেন এ ক্যাচফ্রেজ। জার্মানির বিপক্ষে এইচ জি ওয়েলসের শক্ত অবস্থান মানুষ উপলব্ধি করতে পেরেছিল ভীষণভাবে। বলা যায় নিবন্ধ লিখেই তিনি মানুষের ইচ্ছার কাছাকাছি যেতে পেরেছিলেন। কাজেই একটা শক্তিশালী প্রবন্ধের গুরুত্বকে কখনো ছোট করে দেখার সুযোগ নেই।
সাইফুর রহমান হয়তো এখনো কোনো ক্যাচফ্রেজ তৈরি করতে পারেননি। তবে তার লেখার গতি ধীরে ধীরে পাঠকের নাড়ি বুঝতে শিখেছে। সম্ভবত এ কারণে আজকাল তার অনেক লেখাই অনলাইন জরিপে শীর্ষে অবস্থান করছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, তার লেখায় যে একটা হৃদয়গ্রাহী রসোত্তীর্ণ ব্যাপার আছে, সেটা আমাদের সমকালীন বাংলা নিবন্ধে আজকাল বড় একটা চোখে পড়ে না।
প্রতিটি নিবন্ধেই তার ব্যক্তিগত বিপুল পাঠাভ্যাসের প্রতিফলন ঘটে। আর সাহিত্যকে আশ্রয় করে থাকার ফলে তার লেখায় এক ধরনের প্রাণ প্রতিষ্ঠা পায়। বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যে প্রমথ চৌধুরী কিংবা বুদ্ধদেব বসু যে রকম একটা সৌরভ ছড়িয়েছিলেন সেটার রেশ সাইফুর রহমানের লেখনীতে পাঠক অবশ্যই খুঁজে পাবেন। আর এখানেই সাহিত্যিক ও নিবন্ধকার হিসাবে সাইফুর রহমানের কৃতিত্ব।
প্রবন্ধ সংগ্রহের বই হিসাবে ভিঞ্চির কালো জুতো সাইফুর রহমানের তৃতীয় বই। এর আগে জানা বিষয় অজানা কথা এবং যুক্তিতর্ক ও গল্প নামে তার আরও দুটি প্রবন্ধ সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। সেগুলোর বিপুল পাঠকপ্রিয়তাই তার এই তৃতীয় বই প্রকাশনার পেছনের প্রেরণা। আগের গ্রন্থগুলোর মতো লেখকের এ গ্রন্থটিও পাঠকের ভালোবাসা লাভ করুক এই প্রত্যাশা করি।