১৯৫১ সালের ১৭ মে গুজরাটের জোতপুরে জন্মগ্রহণ করেন পঙ্কজ উদাস। মূলত গজল গায়ক হিসেবে তিনি ব্যাপক পরিচিতি পান। ১৯৮০ সালে ‘আহাট’ শিরোনামের গজল অ্যালবাম প্রকাশ পায়। পঙ্কজ কৃষক পরিবারে জন্ম নিয়েও নিজের গানের সুরে চারদিক আলো ছড়িয়েছেন। ক্যারিয়ারে উপহার দিয়েছেন অসংখ্য জনপ্রিয় গান।
পঙ্কজের দুই ভাই নির্মল ও মানহার উদাস গান করতেন। সে সময় গানের জগতে সফলতার খাতায় নাম লেখান তারাও। মাত্র পাঁচ বছর বয়সেই গানের প্রতি ভালোবাসা জন্ম নেয় এই গায়কের। সে থেকেই সংগীতই ধ্যানজ্ঞান হয়ে ওঠে তার।
১০ বছর বয়সেই মঞ্চে গাওয়ার জন্য ডাক পড়ে পঙ্কজের। একদিন মঞ্চে তার গাওয়া ‘অ্যায় মেরে ওয়াতান কে লোগো’ গানটি শুনে রীতিমতো মুগ্ধ হয়েছিলেন দর্শক-শ্রোতারা। একসময় এই গায়ককে নিয়ে ভিড় লেগে যায়। আর সেই ভিড়ের মধ্যেই তার গান শুনে মুগ্ধ হয়ে গায়কের পকেটে ৫১ রুপি বকশিশ দেন এক ভক্ত। সেটাই ছিল গান গেয়ে পঙ্কজ উদাসের প্রথম প্রাপ্তি। ‘অ্যায় মেরে ওয়াতান কে লোগো’ গানটি চীন-ভারত যুদ্ধে নিহত শহিদদের শ্রদ্ধা জানাতেই তৈরি করেছিলেন কবি প্রদীপ ও সংগীত পরিচালক শ্রী রামাচন্দ্র।
একটা সময় উদাস পরিবার গুজরাট থেকে মুম্বাইয়ে চলে আসে। সেখানে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হন পঙ্কজ উদাস। বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ডিগ্রি নিয়ে নিজের পড়াশোনা শেষ করেন। পরবর্তীতে ক্ল্যাসিক ভোকাল মিউজিকে মুম্বাইয়ের মাস্টার নাভরাং থেকে ট্রেনিং নেন তিনি।
ভারতের শাস্ত্রীয় সংগীতে দক্ষতা অর্জনের সেই সময় প্রথম ‘কামনা’ নামে একটি সিনেমায় গান গাওয়ার সুযোগ হয় পঙ্কজ উদাসের। তবে সিনেমাটি ফ্লপ হলেও তার গাওয়া গানটি প্রশংসিত হয় দর্শক-শ্রোতা মহলে।
পরে গজলের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায় পঙ্কজ উদাসের। উর্দুতেও নিয়মিত গজল গাইতে থাকেন তিনি। যদিও তখন স্বল্প পরিসরে পাড়া–মহল্লায় গজল গেয়ে প্রশংসা কুড়ান এই গায়ক। এর পাশাপাশি গজলের অ্যালবাম করবেন বলে মনস্থির করেন পঙ্কজ উদাস। যেই কথা সেই কাজ। অবশেষে ১৯৮০ সালের দিকে ‘আহাট’ নামে গজলের অ্যালবাম বের করার সুযোগ পান তিনি।
‘মুকারার’, ‘তারান্নাম’, ‘ম্যাহফিল’সহ একাধিক অ্যালবাম দিয়ে রীতিমতো তারকা বনে যান তিনি। শ্রোতামহলে পৌঁছে যায় তার জাদুকরি কণ্ঠ। সব শ্রেণির ভক্তদের হৃদয় জয় করতে থাকেন পঙ্কজ উদাস। গজলশিল্পী হিসেবে দ্রুত পরিচিতি বাড়তে থাকে তার।
পঙ্কজ উদাসের গাওয়া বেশ কিছু জনপ্রিয় গজল হলো— ‘চান্দি জ্যায়সা রং’, ‘না কাজরে কি ধার’, ‘দিওয়ারো সে মিলকার রোনা’, ‘আহিস্তা’, ‘থোড়ি থোড়ি পেয়ার করো’, ‘নিকলো না বেনাকাব’সহ আরও অনেক গান। থাকে। সে সময় গজলের গায়ক হিসেবে কানাডাসহ বিভিন্ন দেশের কনসার্টে ডাক পড়তে থাকে এই সংগীতশিল্পীর।
১৯৮৬ সালে পুনরায় চলচ্চিত্রের গানে নাম লেখান পঙ্কজ উদাস। সেই গানটি ছিল—‘চিঠঠি আয়ি হ্যা, আয়ি হ্যা, চিঠঠি আয়ি হ্যায়’। এই গান সব মহলে তুমুল আলোচিত হয়। এরপরই মূলত একের পর এক সিনেমায় গান গাওয়ার জন্য ডাক পান তিনি। পরবর্তীকালে সিনেমায় গানই তাকে ভারতীয় উপমহাদেশে শ্রোতাদের কাছে পঙ্কজ উদাস হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়।
ছয় দশকের সুরের সফরে দেশ-বিদেশের একাধিক সম্মানে ভূষিত হয়েছেন পঙ্কজ। ২০০৬ সালে ভারত সরকার তাকে পদ্মশ্রী সম্মানেও ভূষিত করে। তবে সবচেয়ে বড় পুরস্কার হয়তো শ্রোতাদের কাছের মানুষ হয়ে ওঠা। গান ছিল যে সম্পর্কের বন্ধন। মনে রাখতে হবে, জগজিৎ সিংয়ের পরে পঙ্কজ উদাস সেই শিল্পী, যিনি গজলকে সাধারণ শ্রোতাদের মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন। দশ বছর বয়সে চীন-ভারত যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে যে প্রতিভার বিস্ফোরণ, তার অন্ত হলো ৭২ বছর বয়সে। সোমবার না ফেরার দেশে পাড়ি দেন বিখ্যাত গায়ক পঙ্কজ উদাস। কিংবদন্তি গজল সম্রাটের গানের চিঠি চিরকাল বুকে করে রাখবেন শ্রোতারা।