হায়েনার মতো লুকিয়ে আছে ষড়যন্ত্রকারীরা: ফখরুল
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০:০৮ পিএম
স্বৈরাচারী সরকারের দোসররা হায়েনার মতো অপেক্ষায় আছে, তারা যে কোনো সময় আক্রমণ করতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি বলেন, ‘স্বৈরাচার সরকারের দোসররা এখন নতুন করে চক্রান্ত করছে। নতুন করে হামলার অপেক্ষায় আছে। এদের প্রতিহত করতে হবে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
শনিবার বিকালে রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে ‘রাজনৈতিক দমন-পীড়নের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণ’ সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
এ সময় জুলাই আন্দোলনসহ বিভিন্ন সময়ে নিহত, আহত এবং গুমের শিকার ব্যক্তিদের আলোকচিত্র তুলে ধরেন স্বজনরা। ভুক্তভোগী কয়েকটি পরিবারের সদস্যরা তাদের অনুভূতি ব্যক্ত করেন। অনেকে কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। স্মরণসভায় বক্তব্যের ফাঁকে ফাঁকে গান পরিবেশন করা হয়, জুলাই অভ্যুত্থান নিয়ে মূকাভিনয় প্রদর্শন করা হয়।
গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে গুমের শিকার ব্যক্তিদের খোঁজ এবং হত্যা-খুনের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের বিচারের দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগী পরিবারের স্বজনরা।
শুক্রবার গোপালগঞ্জে জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের ওপর আওয়ামী লীগের নগ্ন হামলার ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানান বিএনপি মহাসচিব।
এদিকে আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষ্যে পূর্বনির্ধারিত আজকের সমাবেশ বিরূপ আবহাওয়ার কারণে স্থগিত করেছে বিএনপি। ১৭ সেপ্টেম্বর রাজধানীর নয়াপল্টনে এই সমাবেশ করবে দলটি। এছাড়া আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষ্যে রোববার বিভাগীয় শহরে র্যালি করবে বিএনপি।
শনিবার রাত ৯টার দিকে এ তথ্য জানিয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মধ্যদিয়ে আমরা একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পেয়েছি। তাদের কাছে জনগণের প্রত্যাশা আকাশচুম্বী। জনগণ মনে করে, এই সরকার তাদের একটা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করে দেবে। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কার করে নিরপেক্ষ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে যেন গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা হয়।
অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, গত ১৬ বছরে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে হওয়া সব শহিদের জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। যারা পঙ্গু হয়েছেন, নিহত হয়েছেন তাদের রাষ্ট্রীয়ভাবে ভাতা দিতে হবে। যা অত্যন্ত জরুরি। ১৬ বছর ধরে যারা সংগ্রাম করছি তারা অত্যন্ত নির্যাতিত, অত্যাচারিত হয়েছি। আমাদের ৭০০ ভাই-বোন গুম হয়ে গেছে। আয়নাঘর হয়েছে। ছোট্ট শিশুটি এখনো তার বাবাকে খুঁজছে। তাদের খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে এক লাখ ৪৫ হাজার মামলা হয়েছে। ১৭ বছরে ৬০ লাখ মানুষের বিরুদ্ধে মামলা। এসব মামলাগুলো অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।
মির্জা ফখরুল বলেন, গণতন্ত্রের জন্য এই দেশের মানুষ সব সময়ই আত্মত্যাগ করেছে, প্রাণ দিয়েছে। ১৯৭১ সালে আমরা যখন স্বাধীন হয়েছি, তখন ধরে নিয়েছিলাম সত্যিকার অর্থেই একটা গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ পাব। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, আওয়ামী লীগের হাতেই প্রথম গণতন্ত্র ধ্বংস হয়েছিল। তারা (আওয়ামী লীগ) ১৯৭৫ সালে একদলীয় শাসনতন্ত্র কায়েম করে বকশাল প্রতিষ্ঠা করে। এই কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, বারবার স্মরণ করতে হবে। সেই দলটি আবার ২০০৮ সালে নির্বাচনের পর ক্ষমতায় আসার পর অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে তারা গণতন্ত্রকে ধ্বংস করেছে, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করেছে। বারবার ছাত্র-জনতার সংগ্রামকে দমন করার জন্য অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়ন, গুম, হত্যার আশ্রয় নিয়েছে। তার ফলশ্র“তিতে জুলাইয়ের হত্যাকাণ্ড ও তারও পূর্বের ১৬ বছর ধরে এই দেশের মানুষ লড়াই করেছে, প্রাণ দিয়েছে, ত্যাগ স্বীকার করেছে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সব শহিদকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন বিএনপি মহাসচিব। শ্রদ্ধা জানান পঙ্গু ও নির্যাতিতদের।
দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে স্যালুট জানিয়ে বিএনপির মহাসচিব বলেন, তিনি কখনো গণতন্ত্রের প্রশ্নে আপস করেননি। মাথানত করেননি। দীর্ঘ ৬ বছর কারাভোগ করার পর ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্যদিয়ে তিনি মুক্ত হয়েছেন। আজও তিনি অত্যন্ত অসুস্থ। মিথ্যা মামলায় নির্বাসিত হয়ে বিদেশে থেকেও দীর্ঘ বছরগুলোতে তারেক রহমান এ দেশের গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন, সহযোগিতা ও নেতৃত্ব দিয়েছেন।
তিনি বলেন, আজকে সবাই বলছি যে আমরা স্বাধীন হয়েছি। এখনো চতুর্দিকে নাগিনীরা ছড়াচ্ছে নিঃশ্বাস। তাদের চন্ত্রান্ত বিভিন্নভাবে ছড়াচ্ছে। আমাদের বিভক্ত করার চেষ্টা করছে। যে ঐক্য নিয়ে আমরা দীর্ঘ ১৬ বছর লড়াই করেছি, সেই ঐক্যকে আমাদের অটুট রাখতে হবে। কোনোভাবেই তাদের চক্রান্তে পা দেওয়া যাবে না।
বিএনপি নেতাদের ধন্যবাদ জানিয়ে ফখরুল বলেন, আমাদের নেতাকর্মীরা শত প্রলোভন ও উসকানির মধ্যেও শান্ত থেকেছেন। এই দেশেকে রক্ষা করার জন্য তারা কাজ করে যাচ্ছেন। আন্দোলনে যুক্ত বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলোর অবদানের কথা স্বীকার করেন বিএনপির এই নেতা।
এদিকে বৈরী আবহাওয়া ও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে দুপুর থেকেই শহিদ মিনারে ভিড় করেন বিএনপিসহ অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা। বিগত ১৭ বছর ধরে সরকারবিরোধী আন্দোলনে নিহতদের পরিবারের সদস্যরা এই সমাবেশে অংশ নেন। এছাড়া পঙ্গু ও নির্যাতনের শিকার এবং তাদের আত্মীয়স্বজনরা স্মরণসভায় বক্তব্য দেন। স্মৃতিচারণ করে কান্নায় ভেঙে পড়েন অনেকেই। বৃষ্টি উপেক্ষা করে নিহত, পঙ্গু ও নির্যাতনের শিকার ব্যক্তিদের ছবিসহ প্ল্যাকার্ড নিয়ে শহিদ মিনারে অবস্থান করেন তারা। এ সময় মঞ্চ নাটক, সংগীত, কবিতাপাঠ, আবৃত্তিসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড পালন করে বিএনপি।
১৮ জুলাই সাভারে পুলিশের নির্বিচার গুলির পর সাঁজোয়া যানের ওপরে মুমূর্ষু মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) ছাত্র আসহাবুল ইয়ামিনকে ঘোরানো হয়, পরে জীবিত অবস্থায়ই সড়ক বিভাজকে ফেলে দেওয়া হলে সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন ইয়ামিন। তার বাবা মো. মহিউদ্দীন বলেন, ‘বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ, এর থেকে ভারী কোনো বোঝা নেই। আর কোনো বাবা-মা, বোনকে এই নির্মম পরিস্থিতির মুখোমুখি যেন না হতে হয়। কাউকে সাঁজোয়া যান থেকে ফেলে দেওয়ার দৃশ্য আর যেন দেখতে না হয়। কোনো ইয়ামিনকে যেন পুলিশের ঘৃণার পাত্র হতে না হয়। আগামী দিনে পুলিশ যেন তার সঠিক দায়িত্ব পালন করে। আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই এবং শহিদের মর্যাদা দেওয়ার আহ্বান জানাই।’
টাঙ্গাইলে দুই চোখ হারানো হিমেল আহমেদের মা নাসিমা আক্তার বলেন, ‘৪ আগস্টের সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছিল হিমেল। ছিল টাঙ্গাইল শহরের মূল সড়কে একটি মিছিলের নেতৃত্বে। তারা স্থানীয় পুলিশ ফাঁড়ির সামনে পৌঁছালে গুলি ছুড়তে শুরু করে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ওই সময় মিছিলের সামনে থাকা হিমেলের মাথা ও মুখমণ্ডলে শতাধিক ছররা গুলি লাগে। আমাদের পাশে আপনারা দাঁড়াবেন।’
নিহত রিটন চন্দ্র শীলের মা রুবী রানী শীল বলেন, ‘আমার ছেলে ছাত্রদল করত। সে গেছিল তারেক রহমানের মিছিলে। তারে নিয়া নৃশংসভাবে মারছে। আমি তার উপযুক্ত বিচার আপনাদের কাছে চাই। আমার ছোট ছেলেও গুলি খেয়ে চিকিৎসাধীন। আমার সংসারে আর কেউ নেই। খুনি হাসিনার বিচার আমরা চাই।’
টাঙ্গাইলে কলেজের ছাত্র ইমন ৫ আগস্ট শহিদ হয়েছিল। তার মা মানুষের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাতেন। ইমনের ভাই সুমন বলেন, ‘আমরা তিন ভাই। আমার বড় ভাই যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়েন তখন মারা যান। তারপর ইমন ভাই ছিল পরিবারের সব। তিনি নিজে পড়তেন এবং আমাদের পড়াতেন। তিনি গুলি লেগে আহত হয়ে ১৮ আগস্ট হাসপাতালে মারা যান। আমার ভাইকে হত্যা করা হয়েছে, আমি তার বিচার চাই। আমার ভাইয়ের বিচার যেন আমি এ বাংলায় দেখতে পারি।’
বিএনপি নেতাকর্মীদের পাশাপাশি স্মরণসভায় বক্তব্য আরও বক্তব্য দেন, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের জোনায়েদ সাকি, গণঅধিকার পরিষদের (একাংশ) নুরুল হক নুর, জাতীয় দলের চেয়ারম্যান ও ১২ দলের শীর্ষ নেতা সৈয়দ এহসানুল হুদা, ন্যাশনালিস্ট ডেমোক্রেটিক মুভমেন্টের চেয়ারম্যান ববি হাজ্জাজ, দৈনিক ইনকিলাবের সম্পাদক এএমএম বাহাউদ্দীন প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, এজেডএম জাহিদ হোসেন, কেন্দ্রীয় নেতা আবদুল আউয়াল মিন্টু, আমানউল্লাহ আমান, আফরোজা খান রীতা, খায়রুল কবির খোকন, হাবিব উন নবী সোহেল, শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, শিমুল বিশ্বাস, ফজলুল হক মিলন, শিরিন সুলতানা, রাকিবুল ইসলাম বকুল, রফিকুল আলম মজনু, আমিনুল হক, তাবিথ আউয়াল, ইশরাক হোসেন, ছাত্রদলের রাকিবুল ইসলাম রাকিব, নাছির উদ্দীন নাছিরসহ অঙ্গসংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।