মলাট বৃত্তান্ত
হায় হায় কোম্পানি যায় যায় পালিয়ে
শফিক হাসান
প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বর্ষার নতুন পানির ছোঁয়া পেয়ে যেভাবে লাফায় অল্প পানির পুঁটিমাছ, এমএলএম কোম্পানির কাঁচাটাকার গন্ধে তেমন দশাই হলো গালিব রহমানের। নিজেকে বহুস্তরবিশিষ্ট ডাকসাইটে ব্যক্তি ভাবা শুরু করেছিল যেদিন থেকে গলায় টাই উঠেছিল তার! এখন কোম্পানি থেকে পাওনাদি জমা হবে ব্যাংক অ্যাকাউন্টে, তাও ডলারের হিসাবে। এক ডলারের বাংলাদেশি মূল্য ১০০ থেকে ১১০ টাকা; মূল্যস্ফীতির দেশে দাম বেড়ে হাজার টাকায় পৌঁছাতে কতক্ষণ! তখন ডলার বেচেই কাঁড়ি-কাঁড়ি টাকা আয় করা যাবে!
অনাগত দিনের সুবর্ণ স্বপ্নে বুঁদ গালিব তাই ধরাকে সরা জ্ঞান শুরু করল আলাদিনের চেরাগপ্রাপ্তির আগেই। ওর বিয়ে ঠিক হয়ে আছে নাসিমপুর গ্রামের জোছনার সঙ্গে। সম্ভাব্য কাঁচাটাকার ঝনঝনানির গরমে সিদ্ধান্ত নিল বিয়েটা ভেঙে দেবে। দুই-এক বছরেই কোটিপতি হয়ে যাবে গালিব, একযুগ পরে যে হাজার কোটি টাকার মালিক হবে না- সন্দেহ কী! তখন গুলশান-বনানী-ধানমন্ডির ঠিকানা ছাড়া তাকে মানাবেও না। বউয়ের নামটা বড্ড সেকেলে- গালিবের হবু বউয়ের নাম হওয়া উচিত সানজিদা, আলিশা, শিপ্রা-জাতীয় কোনো আধুনিকা!
ভবিষ্যৎ-স্ট্যাটাসে মত্ত গালিবের চিন্তাজাল ছিন্ন করে থালা-বাটি হাতে প্রবেশ করেন মা। বলেন, ‘খাইয়া ল, বাপ।’
মিষ্টিকুমড়া ভাজির সঙ্গে পানি-পাতলা মসুরির ডাল দেখে নিজেকে সামলাতে পারেন না এমএলএম সাহেব, ‘ছোটলোকের মতো এসব কী রান্না কর প্রতিদিন? তোমরা উচ্চ-সংস্কৃতি শিখবে কবে?’
মা অবাক গালিবের উচ্চাকাঙ্ক্ষায়, ‘আমরা তো গরিবই, বাজান। তোর বাপ বাজারে কুলি-মজুরি কইরা কয় ট্যাকাইবা কামায়? খোয়াব দেখছস বাজান?’
‘তবুও এসব চলবে না। তুমি দেখ না, আমি এখন পালিশ-শু পরি, ইন-করা শার্ট-প্যান্টে টাই লাগাই, পারফিউম মাখি?’
‘কিন্তু তোর বাপ তো হেই আদ্যিকালের ছেঁড়া লুঙ্গি, ফাটা গেঞ্জি, তালি-মারা স্যান্ডেলই পিন্দে! শইল্যে ঘামের গন্ধ...।’
‘এখন থেকে এসব বাদ। প্রতি সপ্তাহে ফিস্ট হবে।’
‘ফিশ? মাইনে মাছ খাবি! আইচ্ছা খাইস।’
ফুড ফেস্টিভ্যালের বিষয়টা বোঝাতে না পেরে রাগে-দুঃখে বেরিয়ে গেল গালিব। পেছনে পড়ে রইল মায়ের বিস্ময়মাখা দৃষ্টি, ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত আর স্ট্যাটাসহীন তরকারি। মেঠোপথে গালিব হনহন হাঁটতে থাকে, করোটিজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে লোভনীয় সুখাদ্যের ভুরভুরে ঘ্রাণ!
দুই.
যারাই বড় হয়েছে জীবনে ও সমাজে, বাড়িয়ে নিয়েছে ঠাটবাট প্রত্যেকেই ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আপন-পর সবার সঙ্গেই পাতিয়েছে মধুর সম্পর্ক। ব্যবসায়িক পলিসি হিসাবে গালিবও মাথা ঠান্ডা রাখতে শুরু করল। আশপাশের সবাইকে বড় স্বপ্ন দেখিয়ে শুরু করল অমূল্য মোটিভেশন। কোম্পানিতে পজিশন পোক্ত করতে দরকার হাজারও নতুন সদস্য, আরও লাখো কোটি টাকার বিনিয়োগ। এ টাকার লভ্যাংশের বড় একটি অংশ জমা হবে গালিবের ব্যাংক-হিসাবে। ইতোমধ্যে জীবনমানে পরিবর্তন এসেছে। সুন্দর পোশাক পরিধানের পাশাপাশি বাজার-সদাইও ভালো হয়েছে। নিয়মিত মাছ-মাংস কেনা দেখে তাক লেগে গেছে প্রতিবেশীদের। পতঙ্গ আগুনে ঝাঁপ দিতে এর বেশি আলো লাগে না! অল্প দিনেই গালিব কোম্পানিতে সিইও-তুল্য পদ অলঙ্কৃত করল। স্যারেরা বোঝালেন আরেকবার পদোন্নতি পেলে গালিবকে কোম্পানির পক্ষ থেকে চালকসহ গাড়ি দেওয়া হবে। গাড়ির সামনে ঝুলবে বড় কর্মকর্তার ব্যাজ ও কোম্পানির পতাকা।
যেভাবেই হোক গালিবকে পূর্ণ সিইও হতেই হবে। অফিসার শব্দটির ভাবই আলাদা, মজায় মজা! নতুন বিনিয়োগকারী কোথায় খুঁজবে? ভাবতে ভাবতে মাথায় এলো জোছনার কৃষিজীবী বাবার নাম। একটা শক্ত লিংক পেলে গুলশান-ধানমন্ডি থেকেও বের করতে পারবে শক্ত ‘আউটলেট’।
বিয়ের আগেই জামাইয়ের খোমা এতটা তেলচিটচিটে হয়ে গেল কীভাবে! গালিবের আনা উপঢৌকন, সঙ্গে ওর আত্মবিশ্বাসী ভাবভঙ্গি বিভ্রান্ত করে তুলল জোছনার বাবাকে। পরক্ষণেই গালিবের প্রস্তাবে হুঁশ ফিরলেন, ‘আব্বাজান, আপনি বাড়ি বন্ধক দিয়ে, সব খেত-খামার বিক্রি করে আমার কোম্পানিতে বিনিয়োগ করেন। ছয় মাস পরে দ্বিগুণ টাকা ফেরত পাবেন। আপনিও হতে পারবেন আমার মতো বড় অফিসার!’
‘না, বাপজান, অতি লোভে তাঁতি নষ্ট। আমি এমনিতেই বালা আছি।’
‘ভালো আছেন কীভাবে, আপনার তো এয়ারকুলার নেই, ১২২ ইঞ্চি রঙিন টেলিভিশনও নেই! আর লোভ বলছেন কেন? হালাল ব্যবসা। বিয়ের জন্য কেনা জোছনার স্বর্ণালংকারগুলোও আমাকে দিন। পরে সুদাসলে আরও সুন্দর-দামি গহনা কিনে দেব। কথা ক্লিয়ার?’
জামাইদায়গ্রস্ত পিতার কোনো আপত্তিই শেষ পর্যন্ত টেকে না। অল্প দিনেই পাল্টে যায় জমির মালিকানা! আর জোছনা? ওর বুকে জায়গা করে নেয় সুদর্শন নায়কের রঙিন ভিউকার্ড!
তিন.
ছয় মাস ফুরানোর আগেই অনেক ঘটনা ঘটে যায়। একদিন গালিব আবিষ্কার করে, অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উঠাতে পারছে না; সাধের কোম্পানিও রাতারাতি গায়েব! পাসপোর্ট-ভিসা না থাকায় গালিবের জায়গা হয় জেলখানায়। এদিকে বাড়িতে পাওনাদারের ভিড় বাড়তেই থাকে। দিশেহারা হতে থাকেন বাবা-মা, শ্বশুর-শাশুড়ি। মায়ের বিলাপে গাছের পাতা ঝরে, ‘এমন লোভী-বাটপার পোলা আমি কোন কুক্ষণে পেটে ধরছিলামরে...!’