এ জগৎ সংসারে পাঁচটা রাজাই রাজত্ব করবে আজীবন। চারটা তাসের আরেকটা বাসের। মন মতলবি বাসের ড্রাইভার কখন স্টার্ট দেবে, কেউ কি জানে?
পনেরো মিনিট যাবত লোকাল বাসে গরমে সিদ্ধ হতে হতে সিদ্ধহস্ত মিজান সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। বসকে বলে কয়ে তাড়াতাড়ি অফিস থেকে বের হয়ে কী লাভ হলো? আজও মনে হয় রাস্তার জ্যামে আটকে, বাসে লটকে ইফতার করতে হবে। এদিকে বাসায় চলছে চরম অশান্তি। প্রতিদিনই জ্যামে আটকে থেকে ইফতারের আগে ঘরে ফিরতে না পারায়, ক্ষোভে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন, ‘জ্যাম-জেলিতে ইফতার, আহ্? কী সুখ!’ সেই স্ট্যাটাস পড়ে বউয়ের নিশ্চিত ধারণা হয়েছে, জেলি নামের কারও সঙ্গে স্পেশাল ইফতার পার্টি শেষ করেই ঘরে ঢোকেন মিনমিনা স্বভাবের মিজান সাহেব। আজও যদি বাসায় ইফতার না করা যায়, বউ সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখবে বলে দিয়েছে। গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে বাসের দিকে নজর দিলেন মিজান। ছোট্ট মুড়ির টিনে আক্ষরিক অর্থেই তিল পরিমাণ জায়গা খালি নেই।
প্রচণ্ড গরমে ধারণ ক্ষমতার চারগুণ যাত্রী নিয়ে বাস দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই। হেল্পার বাসের দরজা থাবড়াতে থাবড়াতে তবু বিপুল উৎসাহ নিয়ে ডেকে যাচ্ছে, ‘হারম গেট, হারম গেট, পিছনে সিট খালি, রড খালি।’
আর যায় কই? ত্যক্ত বিরক্ত ডেইলি প্যাসেঞ্জারদের হালি হালি গালি মিসাইল বেগে হেলপার বরাবর ছুটতে শুরু করল।
‘ওই নবাবজাদা, পিছনে আয়। খালি কই, দেখাইয়া দিয়া যা।’ এ পর্ব শেষ হতে না হতেই আরেক যাত্রীর উচ্চমার্গীয় বাণী জনস্বার্থে সম্প্রচার শুরু হয়ে গেল। এ পর্বে হেলপারের জন্ম ইতিহাস হতে শুরু করে কিছুই বাদ যাচ্ছিল না। মিজান সাহেব ভাবলেন, ধৈর্য শক্তিতে নোবেল পুরস্কার থাকলে হেলপারের পদক জয় নিশ্চিত। এত লোকের বাক্য-কামানে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে বাসের ঝাঁঝরা হওয়া বডি থাপড়িয়ে আরও জোরে ডাকতে থাকল, ‘হারম গেট, হারম গেট!’
রাগ ঝাড়ার দারুণ উপায় শুধু ফুটবলই না লোকাল বাসও। যতই লাথি মারেন, কেউ কিচ্ছু বলবে না। গালাগালি, লাফালাফির এক পর্যায়ে অবশেষে বাস চলতে শুরু করল এবং এক মিনিটের মাথাতেই আবার থেমে গেল। না থেমে উপায় কী? সবই যে থেমে আছে।
মিজান সাহেব গলা বাড়িয়ে জানালা দিয়ে উঁকি দিলেন। ঢাকার রাস্তায় যানজটের তিন খ্যাতিমান গিট্টু রিকশা, মোটরসাইকেল আর প্রাইভেট গাড়ি রাজপথ আঁকড়ে আছে চারদিক থেকে। যেন বলতে চাইছে, তারা বাদে বাকিদের কারণেই রাস্তায় জ্যামের গিট্টুটা বাঁধে।
ক্লান্তিতে চোখ বুঁজে মিজান সাহেব বিচারকের আসনে বসলেন। সামনে দাঁড়িয়ে আছে প্রাইভেট গাড়ি, মোটরসাইকেল আর রিকশা। প্রথমেই এগিয়ে এলো প্রাইভেট গাড়ি।
প্রাইভেট গাড়ি : এই যে দেখেন বস, রিকশা আর মোটরসাইকেলে গিজগিজ করছে সারাটা রাস্তা। ওদের কিছু কওয়া যায়? রাজপথ, গলিপথ সব তো ওদের দখলেই। এদের ঠেলে গাড়ির চাকা ঘোরানো কার সাধ্যি, আপনিই বলেন?
কোন মুল্লুকে কোন নগরে এমন রাস্তা আছে?
প্রাইভেট গাড়ি পাত্তা পায় না রিকশা, হোন্ডার কাছে!
মোটরসাইকেল : চিল্লান দিলেই কী মার্কেট পাওন যায় রে? মানুষের কী চোখ নাই? প্রাইভেট গাড়ি আর রিকশার দিকে চোখ যায় না? তোরাই তো যানজটের আসল কারণ। আমরা জ্যামের কারণ হতে যাব কেন? ফুটপাথ বলেন আর চিপা-চুপা বলেন, আমরা ঠিক পথ বানিয়ে নিয়ে বের হয়ে যাই। আমরা কী রাস্তায় বসে থেকে জ্যাম করি?
ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যাম, এমনি এমনি হয়?
প্রাইভেট আর রিকশাই তো রাস্তায়, পাটি পাইত্যা লয়।
রিকশা : ঢাকা শহরে যত প্রাইভেট গাড়ি আর মোটরসাইকেল চলে তারপর কী রাস্তায় চলার মতো কোনো জায়গা থাকে? তেনাগোর চলার ইস্টাইল দেখছেন? যেইভাবে উইড়া আইসা গায়ের উপর পড়ে, রাস্তা যেমন হেগো বাপ-দাদার! বিপদে কিন্তু আমরাই আপনার বন্ধু, তাই আসেন জোর আওয়াজ তুলি-
হোন্ডা চালায় গুন্ডা আর প্রাইভেট বড়লোক,
তেল, গ্যাস, ধোঁয়াবিহীন রিকশা সবার হোক।
তিন দলের টানাটানিতে চোখ মেলে তাকাতেই দেখলেন, তাকে ধরে টানছে বাস কন্ডাক্টর, ‘ও মামা, আর কতক্ষণ ঘুমাইবেন,
ইফতারের সময় তো হইয়া গেল, ইফতার করবেন না?’