আলকাস আলহাট চকবাজার থেকে পাইকারি দরে বারো ডজন কলম কিনলেন। রংবেরঙের কলমের চোখা নিবসমগ্র তাকেই উপর্যুপরি ‘বেয়োনেট চার্জ’ করতে থাকবে বুঝতে পারলে দাঁতের মাজন কিনতেন। দাঁত পরিষ্কার থাকত, সুযোগ বুঝে জায়গামতো কালো মাজন দিয়ে আঙুলের ছাপও দিতে পারতেন।
নতুনধারার অটোগ্রাফ নিশ্চয়ই মানুষ লুফে নিত। কিন্তু এটা কী হলো! প্রকাশক বইমেলার প্রথম দিন থেকেই তার কাব্যবইটি স্টলে তুলেছেন। কল করে বলেও দিয়েছেন, ‘ইয়ার-দোস্ত, পাড়াপ্রতিবেশী নিয়া বইমেলায় আইসেন। অটোগ্রাফ দিয়া বেইচেন। কলম লগে রাইখেন। স্টলের কলম মাইরা দিয়েন না।’
নানান কিসিমের কলম আঁটি বেঁধে ১ ফেব্রুয়ারির সন্ধ্যায় বইমেলায় প্রবেশ করছিলেন, পেছন থেকে একজন চড়াকণ্ঠে বলল, ‘ভাই, কলম কত?’
দাঁত-মুখ খিঁচিয়ে বললেন, ‘কলমের ফেরিওয়ালা মনে হয়? আমি কবি। অটোগ্রাফ দেওয়ার জন্য কলম কিনেছি।’
‘এত্ত কলম! আমি এক কলমেই দশ বছর চালিয়ে দিই।’
‘আপনার পরিচয়?’
‘আমিও কবি। কাব্যদেবীর জাদু প্রকাশনী থেকে বেরিয়েছে আমার দ্বাবিংশ কাব্যগ্রন্থ- বুকের মাঝে তুই পাটখেতেও তুই।’
তরুণ কবি আলকাস আলহাটের মনে পড়ে গেল প্রকাশকের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের কথা। পান চিবুতে চিবুতে প্রশ্ন করলেন প্রকাশক, ‘কয়’শ কপি বই ছাপবার চান?’
‘অন্তত তিন লাখ কপি তো লাগবেই।’
‘কী যা তা কন! তিন লাখ বইয়ের দাম কত- ধারণা আছে?’
ক্যালকুলেটরে তিনি তিন লাখকে তিনশ টাকায় গুণ দিলেন। অঙ্কটা দেখে মাথা ঘুরে যাওয়ার দশা। বাধ্য হয়ে প্রকাশককে বললেন, ‘কোটি টাকার হিসাব আমি পারি না!’
‘বুঝছি, আপনে অঙ্ক কাঁচা কবি। বই ছাপব একশ বিশ কপি। টাকা দিয়া যান।’
পাটখেত কবিকে পাত্তা না দিয়ে সামনে বাড়লেন আলকাস আলহাট। একটি স্টল থেকে ডাক এলো, ‘ঝরনা কলম আছে?’
তিনি বুঝলেন কান বেঁধে মাছ বহন করার মতো কলমগুলোকে রশি দিয়ে বহন ঠিক হয়নি। লোকজন তার সম্মানজনক পরিচয় ভুলে যাচ্ছে! স্টলকর্মীকে বললেন, ‘৯৮৭ নম্বর স্টলের সামনে আসেন। কবিতাবই কিনলে বলপেন ফ্রি পাবেন।’
আলকাস আলহাট নিজ স্টল বকবিতা প্রকাশনীর সামনে এসে দাঁড়ালেন। তাজ্জব ঘটনা, সামনে দাঁড়িয়ে একজন পাঠক তার বইটিই পড়ছেন নিবিষ্টভাবে। ছোঁ মেরে পাঠকের হাত থেকে বইটি নিয়ে বললেন, ‘চিন্তা নেই। আমি এসে গেছি। অটোগ্রাফ পাবেন। ফটোগ্রাফও হবে, এরপর আমাজন কফি। তারপরে আড্ডা!’
ছয়রঙা কালির ছয়টি কলম ব্যবহার করে ধুমসে লিখে চলেছেন তিনি। পুস্তানি থেকে শুরু করে পরপর তিন পৃষ্ঠায় PTO লিখে চতুর্থ পৃষ্ঠায় স্থিত হলেন। লিখতে লিখতে একবার তাকালেন সামনে। কী কাণ্ড, ভক্তের ছায়াও নেই! হতভম্ব হয়ে স্টলকর্মীকে বললেন, ‘সুবর্ণা, আমার কাস্টমারটা কই?’
‘কীসের কাস্টমার? তিনি কি বলেছেন বই কিনবেন! আর আমার নাম সুবর্ণা, কে বলেছে?’
‘সুন্দর বর্ণের সমষ্টি দিয়ে সুন্দর মানুষের নাম সুবর্ণা হওয়াই বাঞ্ছনীয়!’
‘আপনি তো দেখছি আসলেই কবি। গরু বানানেও ‘ও’কার দিতে হচ্ছে আপনাদের মতো তালগোলহীন মানুষের জন্যই। বউনি হয়নি, নষ্ট-করা বইয়ের টাকা দেন!’
নিজের বই কেউ নিজে কেনে নাকি! টাকা দিলেন না। স্টলের তিনদিকে চক্কর মারলেন। কোথায় তার চেনা-অচেনা পাঠককুল! কলমের বোঝায় হাতে টনটন ব্যথা করছে। ভ্রাম্যমাণ চিত্রশিল্পী এসে বললেন, ‘স্যার, আপনার হাতে বর্ণমালা এঁকে দিই? দশ টাকায়!’
‘তুমি আমার পিঠে পাঞ্জাবির উপরে লিখে দাও- বই কিনলে অটোগ্রাফ ফ্রি; এসো সেলফি তুলি!’
পিঠ-লিখনের পরেও মিলল না প্রত্যাশিত সাড়া। বাধ্য হয়ে মেলা প্রদক্ষিণের সিদ্ধান্ত নিলেন কবি। টাকালোভী সুবর্ণা কটমট করে তাকিয়ে থাকল তার দিকে!
হাঁটতে হাঁটতে আবিষ্কার করলেন, দেশের সবচেয়ে বড় কবির বইও বিক্রি হচ্ছে না। উপরন্তু একটি স্টলে বিশ টাকায় বইয়ের সঙ্গে ছবি তুলে দেওয়া হচ্ছে। ‘পাঠকের’ পছন্দের যে কোনো ধরনের বইয়ের নাম বললেই হাজির করছে। তারা এসব ছবি পোস্ট করে কিংবা লেখকের মেসেঞ্জারে দিয়ে বলতে পারবে- বই কিনেছি! আলকাস আলহাট ক্ষুব্ধকণ্ঠে বললেন, ‘আমাদের বই বিক্রি হয় না, আর তোমরা এখানে অনৈতিক বাণিজ্য করছ! আর আমি কলমের ভার নিয়ে ঘুরে মরছি!’
একজন জবাব দিল, ‘কলমের ব্যবসাই তো ভালো। আমাদের প্রকাশকও কলমের ফ্যাক্টরি দিয়েছেন!’
আলকাস আলহাট ভাবলেন, মেলা ও মেলার বাইরে সব ধরনের কবিতার বই সেরদরে বিক্রি করে দিতে পারলে তিনিও কলমের ফ্যাক্টরির মালিক হতে পারবেন। সেই ফ্যাক্টরির ম্যানেজারের চাকরি অফার করবেন সুবর্ণাকে!