Logo
Logo
×

শেষ পাতা

সংস্কার কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন

অবৈধ আয় বৈধের পথ বন্ধের সুপারিশ

দুদককে শক্তিশালী করতে রাজনীতি ও আমলানির্ভরতা কমানোর প্রস্তাব

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

অবৈধ আয় বৈধের পথ বন্ধের সুপারিশ

ছবি: সংগৃহীত

বৈধ কিন্ত উৎসবিহীন আয়কে বৈধতা দেওয়ার যে কোনো রাষ্ট্রীয় চর্চা স্থায়ীভাবে বন্ধের সুপারিশ করেছে দুদক সংস্কার কমিশন। তারা মনে করে, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তফসিলভুক্ত যে কোনো অপরাধের ক্ষেত্রে তদন্তপূর্ব আবশ্যিক অনুসন্ধানের ব্যবস্থা বাতিল করা দরকার। এছাড়াও সংস্থাটিকে শক্তিশালী করতে রাজনীতি ও আমলানির্ভরতা কমানোসহ ৪৭ দফা সুপারিশ করেছে কমিশন। ব্যক্তিগত স্বার্থে সাংবিধানিক ও আইনগত ক্ষমতার অপব্যবহার ও ঘুস লেনদেনকে অবৈধ ঘোষণা এবং আইনে কালোটাকা সাদা করার ব্যবস্থা স্থায়ীভাবে বন্ধে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনের আওতায় সরকারি খাতের মতো বেসরকারি খাতেও ঘুস লেনদেন অবৈধ, কিন্তু সেটা এখনো কার্যকর হয়নি। এটা কার্যকর করতে হবে।

দুদকে নিয়োগের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সুনির্দিষ্ট সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতা বিবেচনায় একজন নারীসহ পাঁচজন দুদক কমিশনার নিয়োগের সুপারিশ করা হয়েছে। তাদের মেয়াদ হবে চার বছর। দুদকে শৃঙ্খলা অনুবিভাগ রাখার সুপারিশ করা হয়েছে। এর দায়িত্ব হবে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে বরখাস্ত করা। দুদকের ভেতরের দুর্নীতি বন্ধে কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের মাধ্যমে নজরদারি অব্যাহত রাখার সুপারিশও করেছে কমিশন।

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশে ছেড়ে পালানোর পর অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। এই সরকার বিভিন্ন খাতে সংস্কারের জন্য কমিশন গঠন করে। গত অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে দুর্নীতি দমন কমিশন সংস্কারে কমিশন গঠন করা হয়। ড. ইফতেখারুজ্জামানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন গত ৩ অক্টোবর কার্যক্রম শুরু করে। গত শনিবার কমিশন পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন জমা দেয়।

জানা গেছে, দুর্নীতি দমন কমিশন আইন, ২০০৪; ধারা-৭ এর অধীন গঠিত বাছাই কমিটির নাম পরিবর্তন করে ‘বাছাই ও পর্যালোচনা কমিটি’ নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়েছে। দুদককে শক্তিশালী, কার্যকর ও ন্যায়পাল প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে কমিশনারদের পদ বাড়ানো, নিয়োগ, সার্চ কমিটি, আইনের সংস্কার, বেতন বৃদ্ধি ও প্রণোদনার জন্য সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। তারা বলছে, দেশে জাতীয় দুর্নীতিবিরোধী কোনো কৌশল নেই। দুর্নীতি দমন শুধু দুদকের একার কাজ নয়, এখানে রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় অনেক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা রয়েছে। যেমন সংসদ, আইন ও বিচার বিভাগ, প্রশাসন, সেনাবাহিনী, বিভিন্ন কমিশন, ব্যবসা খাত ও রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজের দুর্নীতিবিরোধী ভূমিকা থাকতে হবে। যে জাতীয় কৌশল প্রণয়নের কথা বলা হচ্ছে, তাতে রাষ্ট্রীয় ও অরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা নির্ধারণ করা থাকবে। যার মাধ্যমে দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপগুলো কতটুকু বাস্তবায়িত হচ্ছে, তা নিয়মিতভাবে নজরদারি করতে হবে।

দুর্নীতি দমনে সব সেবামূলক খাত স্বয়ংক্রিয় বা অটোমেশনের আওতায় আনার সুপারিশ করেছে কমিশন। কমিশন বলছে, বেসরকারি খাতে ঘুস লেনদেন এখন পর্যন্ত অবৈধ নয়। আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী কনভেনশনের আওতায় সরকারি খাতের মতো বেসরকারি খাতেও ঘুস লেনদেন অবৈধ, কিন্তু সেটা এখনো কার্যকর হয়নি। দুদককে শক্তিশালী করতে কয়েকটি আইন সংস্কারের তাগিদ দিয়েছে কমিশন। দুর্নীতির তথ্য প্রকাশকারীর সুরক্ষা আইন এর একটি। যে দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করেন, তার সুরক্ষায় আইন করতে হবে। তথ্য প্রকাশ সুরক্ষা আইন রয়েছে, তবে এর কোনো প্রয়োগ ও কার্যকর প্রচার নেই। এ আইন যথেষ্ট নয়। তাই আইনটি সংশোধন করে কার্যকর ও প্রচারের সুপারিশ করা হয়েছে।

অর্থ পাচার বন্ধে সুনির্দিষ্ট কিছু আইন করার কথা বলেছে সংস্কার কমিশন। কমিশনের মতে, সুনির্দিষ্ট আইন না থাকায় অর্থ পাচার বন্ধ করা যাচ্ছে না। কমিশন বলছে, যে ব্যক্তি একটি প্রতিষ্ঠান ও মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে আছেন, তিনি ব্যক্তিগত স্বার্থ ও বন্ধুত্বের বলয় থেকে সিদ্ধান্ত নেন। এটা বন্ধে স্বার্থের দ্বন্দ্ব নিরসন আইন দরকার।

রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি আয়-ব্যয় নিয়মিত প্রকাশের ওপর গুরুত্বারোপ করেছে সংস্কার কমিশন। তাদের মতে, রাজনৈতিক দলের নির্বাচনি আয়-ব্যয় নিয়মিত প্রকাশ করতে হবে। হলফনামার তথ্য প্রকাশ করতে হবে। যদি হলফনামায় পর্যাপ্ত তথ্য না থাকে, তথ্য গোপন করা হয় ও বৈধ আয়ের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পদ থাকে, তবে তার জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। স্থানীয় থেকে জাতীয়, সব পর্যায়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার তিন মাসের মধ্যে তাদের পরিবারের সবার সম্পদের বিবরণী নির্বাচন কমিশনে জমা দেবেন। সেটি নির্বাচন কমিশন প্রকাশ করবে। এটি প্রতি বছর হালনাগাদ করতে হবে, যত দিন তারা জনপ্রতিনিধি থাকবেন।

দেশের প্রত্যেক নাগরিকের দেশ-বিদেশে থাকা ব্যাংক হিসাবের লেনদেন ‘কমন রিপোর্টিং প্র্যাকটিস’-এর আওতায় আনার কথা বলেছে কমিশন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটসহ (বিএফআইইউ) সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে এসব লেনদেনের তথ্য জানতে পারবে। বেনামি প্রতিষ্ঠান গড়ে এস আলম কয়েকটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বেনামি কোম্পানির তথ্য প্রকাশ করা হয় না উল্লেখ করে সংস্কার কমিশন বলেছে, তারা মনে করে, বেনামি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে দেশের মানুষ জানে না। তাই বেনামি প্রতিষ্ঠানের মালিকানার তথ্য একটি জাতীয় রেজিস্ট্রারে উল্লেখ থাকা উচিত।

দুদকে সংস্কার কমিশন বলেছে, কমিশনার নিয়োগের ক্ষেত্রে শুধু সংখ্যা বাড়ালে হবে না। যেসব পেশা দুদকের কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বা যুক্ত সেখান থেকে দুদকের বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিতে হবে। শুধু আমলাদের নিয়োগে যে প্রধান্য দেওয়া হয়, তা থেকে সরে আসতে হবে। সংস্কার কমিশন চায় দুদক স্বাধীন ও কার্যকর হোক। তবে দুদকের কোনো স্বাধীনতা সীমাহীন নয়। দুদক যে কাজ করবে, তার জবাবদিহি থাকবে। ভালো কাজের যেমন প্রশংসা থাকবে, তেমন কাজ করতে না পারলে জবাবদিহি করতে হবে।

দুদকের চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগে যে সার্চ কমিটি আছে, তাকে সার্চ ও পর্যবেক্ষণ কমিটি করার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। সার্চ কমিটির দুটি দায়িত্বের সুপারিশ করা হয়। এর একটি, নিয়োগে যাচাই-বাছাই করা। অন্যটি, কমিশন কী কাজ করছে, তা পর্যবেক্ষণ করে ছয় মাস পরপর প্রতিবেদন দেওয়া। রাজনৈতিক বিবেচনায় দুদকে নিয়োগ বন্ধে সাত সদস্যের বাছাই কমিটি করার সুপারিশ করেছে সংস্কার কমিশন। দুদককে আমলাতন্ত্রমুক্ত করতে সচিব, মহাপরিচালক ও পরিচালক পদগুলোতে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। যারা দুদকের কাজের জন্য নিজেদের যোগ্য মনে করবেন, তারা এসব পদের জন্য আবেদন করতে পারবেন। এ ছাড়া নিজস্ব প্রসিকিউশন বিভাগ ও প্রশিক্ষণ একাডেমি করা, ৫৪-এর ৩ ধারা বাতিল এবং বেতন দ্বিগুণ করার সুপারিশ করা হয়েছে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম