কোনো প্রতিষ্ঠানকেই বন্ধ হতে দেব না। এটাই লক্ষ্য। এস আলমই হোক বা বেক্সিমকোই হোক প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয় সম্পদ। প্রকৃত মালিক থাকুক বা না থাকুক প্রতিষ্ঠানগুলো চালানোর ব্যবস্থা করা হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোতে অনেক কর্মচারী কর্মরত আছেন। দেশ ও উৎপাদনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক আছে, তাদের সঙ্গে ব্যাংকেরও সম্পর্ক রয়েছে। এগুলো তো বিচ্ছিন্ন করা যাবে না। 

কাজেই একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান কিন্তু আলাদা। যাতে ফান্ড ডাইভারশন না হয়। সে প্রচেষ্টা থাকবে। কোনো প্রতিষ্ঠানকে মরতে দেব না। প্রতিষ্ঠান মারা খুব সহজ কিন্তু গড়ে তোলা অনেক কঠিন এবং অনেক সময়ের ব্যাপার। প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে দেশ এবং দেশের মানুষ সবাই উপকৃত হয়। ব্যর্থ হতে চাই না। প্রতিষ্ঠানগুলোকেও ব্যর্থ হতে দেব না। 

সোমবার বাংলাদেশ ব্যাংকে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর। এ সময় সংবাদ সম্মেলনে ইসলামী ব্যাংকের পুনর্গঠিত পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদসহ পরিচালকরা উপস্থিত ছিলেন। 

সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, সব ব্যাংককে রক্ষা করা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দায়িত্ব। পরিচালনায় বদল এনেও যেসব ব্যাংক এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি, তাদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সব আমানতকারীকে রক্ষা করা হবে। 

আহসান এইচ মনসুর বলেন, অনিয়মের মাধ্যমে যারা ব্যাংক থেকে টাকা নিয়েছেন, সেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আলাদাভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কোনো প্রতিষ্ঠান মরতে দেওয়া হবে না। কারণ সব প্রতিষ্ঠান জাতীয় সম্পদ। এর সঙ্গে ব্যাংকের বিনিয়োগ, উৎপাদন ও সরবরাহ জড়িত। এস আলমের শাস্তির জন্য আদালতে মামলা দায়ের হবে। সেখানেই সিদ্ধান্ত হবে, তাদের কী হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বলেন, তাড়াহুড়া বা ইমোশন অল্প সময়ের জন্য মানুষকে উত্তেজিত এবং উজ্জীবিত করে। কিন্তু ইমোশন দিয়ে দেশ চালানো যায় না, সেটা ভালো হয় না। বাস্তববাদী হতে হবে। পাশাপাশি সঠিক নীতি প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়নের মাধ্যমে পরিবর্তন আনতে হবে। 

তিনি বলেন, সবার আমানতের নিরাপত্তার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। প্রধান লক্ষ্য সবার আমানত ফেরত দেওয়া। এজন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকগুলোকে সহায়তা করা হবে। তবে সেটা এমন নয় যে, বাচ্চা ললিপপ চাইল, আর দিয়ে দিলাম। এ রকম হবে না। সব হিসাব-নিকাশ করে টাকা দেওয়া হবে।

ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ বলেন, এস আলম ইসলামী ব্যাংকের ১৭টি শাখা থেকে ৮০ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে। শুধু টাকা নেয়নি, আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলোর সঙ্গে ব্যাংকের যে সম্পর্ক ছিল, সেটাও ধ্বংস করে দিয়েছে। পাশাপাশি পুরোনো উদ্যোক্তা সৌদি প্রতিষ্ঠান আল রাজিকে আনার চেষ্টা চলছে। আইএফসিকেও যুক্ত করার চেষ্টা করা হবে।

ইসলামী ব্যাংকের উন্নতি হচ্ছে জানিয়ে চেয়ারম্যান ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ বলেন, তিন মাসে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকা আমানত বেড়েছে। প্রবাসী আয় বাড়ছে। নতুন বিনিয়োগ দেওয়া বন্ধ আছে। ব্যাংকের ২ হাজার ৭০০ এজেন্ট পয়েন্টে তিনজন করে কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। তারা ব্যাংকের আমানত বাড়াতে ভূমিকা পালন করতে পারেন।

ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ বলেন, এস আলমের শেয়ার বিক্রির জন্য শিগগিরই আদালতে মামলা করা হবে। এরপর বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) ও বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি নিয়ে এস আলমের মালিকানার মধ্য থেকে ১০ হাজার কোটি টাকার শেয়ার বিক্রি করা হবে।

চেয়ারম্যান আরও বলেন, গ্রাহক এবং বিদেশি গ্যারান্টার ব্যাংকগুলোর আস্থা ফেরানোর চেষ্টা করছি। এস আলমের উৎপাদনরত কোম্পানির এলসিও খুলছি। এস আলমের চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। কিন্তু তার কোম্পানির সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করা হয়। ঋণ আদায় সব রকম প্রচেষ্টায় চলছে বলে জানিয়েছেন ওবায়েদ উল্লাহ আল মাসুদ। 

এস আলমের কোম্পানির ৬০ মিলিয়ন ডলার ইতোমধ্যে বকেয়া হয়ে গেছে। আগামী মাসে আরও ১৮০ মিলিয়ন ডলার ওভারডিউ হবে। গ্রুপটির এলসির বিপরীতে ২০ হাজার কোটি টাকার মতো দায় পরিশোধ করা হয়েছে। এই দায়ের অর্ধেক সমন্বয় করা হবে তার নামে-বেনামে থাকা শেয়ার থেকে। বর্তমানে তার শেয়ার রয়েছে ১৬০০ কোটি, যার বর্তমান শেয়ারমূল্য প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া বাকি ১০ হাজার কোটি টাকার নতুন শেয়ার ইস্যু করা হবে। আল-রাজি, আইএফসিসহ বিভিন্ন সংস্থাকে এখানে বিনিয়োগের আহ্বান জানানো হবে।

প্রসঙ্গত, ২০১৭ সালে মালিকানা পরিবর্তনের পর ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের বিদেশি বিনিয়োগকারীরা শেয়ার ছাড়তে শুরু করেন। এস আলম গ্রুপ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার আগে ইসলামী ব্যাংকের ৫০ শতাংশের বেশি মালিকানা বিদেশিদের হাতে ছিল। এখন যা কমে ১৩ শতাংশে নেমে এসেছে।

এস আলম গ্রুপ ব্যাংকটির নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর ধীরে ধীরে শেয়ার ছেড়ে দেয় ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি), দুবাই ইসলামী ব্যাংক, ইসলামিক ইনভেস্টমেন্ট অ্যান্ড করপোরেশন দোহা, ইসলামিক ব্যাংকিং সিস্টেম ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিং লুক্সেমবার্গ, শেখ আহমেদ সালেহ জামজুম, শেখ ফুয়াদ আবদুল হামিদ আল-খতিব, আল-রাজি গ্রুপ, কুয়েতের সরকারি ব্যাংক কুয়েত ফাইন্যান্স হাউস, সৌদি কোম্পানি আরবসাস ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিস্ট এজেন্সিসহ বেশির ভাগ বিদেশি উদ্যোক্তা ও সাধারণ শেয়ারধারী প্রতিষ্ঠান।