সুদ হার বৃদ্ধিতে বৈষম্য, আমানতকারীরা বঞ্চিত
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৩ মে ২০২৪, ১০:০৪ পিএম
বৈশ্বিক ও দেশীয় অর্থনৈতিক মন্দা এবং আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত বাস্তবায়নে সব ধরনের সুদের হার বেড়েছে। এ হার বৃদ্ধির কথা সমান্তরালভাবে, কিন্তু সেভাবে বাড়েনি। সাধারণ গ্রাহকদের নিরাপদ সঞ্চয়ের সুদ বেড়েছে অতি নগণ্য হারে। ঋণের সুদ বেড়েছে বেশি হারে। এর চেয়েও বেশি বেড়েছে সরকারি স্বল্পমেয়াদি ঋণের উপকরণ ট্রেজারি বিলের সুদ হার।
আমানতকারীদের বেশির ভাগই ব্যাংকে সঞ্চয় করেন। এ খাতে সুদ হার একেবারেই কম বাড়ায় তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। ঋণের সুদ বেশি বাড়ায় চাপের মুখে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদ বেশি হারে বাড়ায় লাভবান হচ্ছে ব্যাংক, ফাইন্যান্স কোম্পানি ও বিমা কোম্পানিগুলো।
সূত্র জানায়, ২০২২ সালের ফেব্র“য়ারিতে রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করলে পণ্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়ে দাম বেড়ে যায়। এর প্রভাবে আমদানি ব্যয়ও বাড়ে। এতে ডলারের চাহিদা বাড়ায় দামও বাড়তে থাকে। এসব মিলে আন্তর্জাতিক বাজারে সুদ হার বাড়তে থাকে। এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশেও। ২০২২ সালের শেষ দিকে ঋণের সুদ হার বাড়তে থাকে। ২০২৩ সালের জুলাই থেকে আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়ন করতে গিয়ে ঋণের সুদ হারের সীমা তুলে নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে সুদ হার পাগলা ঘোড়ার গতিতে বাড়তে থাকে। গত দুই বছরের ব্যবধানে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে সরকারের স্বল্পমেয়াদি ঋণের উপকরণ ট্রেজারি বিলের সুদ। এর পরেই বেশি বেড়েছে সরকারের দীর্ঘমেয়াদি ঋণের উপকরণ ট্রেজারি বন্ডের সুদ হার। আলোচ্য সময়ে আমানতের সুদ হার বেড়েছে একেবারেই কম। ওই সময়ে সরকারের ঋণও বেড়েছে। যে কারণে সুদ হারও বেশি বাড়ছে।
ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে সরকারের ঋণের স্থিতি ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ছিল ৬২ হাজার ১৫০ কোটি টাকা। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ৮৯ হাজার ৪১০ কোটি টাকা। গত ডিসেম্বরে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় এক লাখ ৩৬ হাজার ২১০ কোটি টাকায়।
সরকারের তিন ধরনের ট্রেজারি বিল আছে। তিন মাস, ছয় মাস ও এক বছর মেয়াদি ট্রেজারি বিল। এর মধ্যে ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের গড় সুদের হারের সঙ্গে নির্দিষ্ট অংশ যোগ করে ঋণের সুদ নির্ধারিত হয়। এর সুদ বাড়ায় ঋণের সুদও বাড়ছে।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে তিন মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে সরকারের ঋণের স্থিতি ছিল ১৯ হাজার ৬০০ কোটি টাকা। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার ৩৩০ কোটি টাকায়। গত ডিসেম্বরে তা আবার সামান্য কমে দাঁড়িয়েছে ৩৫ হাজার ৭৪০ কোটি টাকায়। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে তিন মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলে সুদের হার ছিল ২ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গত ডিসেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশে।
ছয় মাস মেয়াদি ট্রেজারি বিলের মাধ্যমে সরকারের ঋণের স্থিতি ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ছিল ১৩ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা। ২০২২ সালের তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার কোটি টাকায়। গত ডিসেম্বরে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ২৮ হাজার ১০ কোটি টাকা। ওই সময়ে সুদ হার ৩ দশমিক ১৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ১১ দশমিক ০৯ শতাংশ হয়েছে।
এক বছর মেয়াদি ট্রেজারি বিলে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে সরকারের ঋণের স্থিতি ছিল ২৮ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। ২০২২ সালে ছিল ৩০ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। গত বছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭২ হাজার ৪৬০ কোটি টাকায়। আলোচ্য সময়ে এর সুদ হার ৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ থেকে বেড়ে ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ হয়েছে।
আলোচ্য সময়ে ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগ দুই লাখ ৮৭ হাজার ৮৪০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে পাঁচ লাখ ১৪ হাজার ৯২০ কোটি টাকা হয়েছে। এর সুদ হারও বেড়েছে। দুই বছর মেয়াদি বন্ডের সুহ হার ৪ দশমিক ৬৮ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৮ দশমিক ৬৯ শতাংশ। পাঁচ বছর মেয়াদি বন্ডের সুদ ৬ দশমিক ৪১ শতাংশ থেকে বেড়ে ১০ দশমিক ৩৫ শতাংশ হয়েছে। ১০ বছর মেয়াদি বন্ডের সুদ ৭ দশমিক ৩৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ১০ দশমিক ৪৬ শতাংশ এবং ২০ বছর মেয়াদি বন্ডের সুদ ৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ থেকে বেড়ে ১১ দশমিক ১৬ শতাংশ হয়েছে।
সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ করছে ব্যাংক, ফাইন্যান্স কোম্পানি ও বিমা কোম্পানিগুলো। সাধারণ গ্রাহকদের এগুলোতে বিনিয়োগ সুযোগ কম। বিনিয়োগ করলে ব্যাংকের মাধ্যমে করতে হবে। বিষয়টি বেশ জটিল। এ কারণে সাধারণ সঞ্চয়কারীরা ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখান না। এগুলোতে বিনিয়োগ করতে হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিলামের মাধ্যমে। ফলে ব্যাংক, ফাইন্যান্স কোম্পানি ও বিমা কোম্পানিগুলোই এতে বিনিয়োগ করে বেশি। এসব উপকরণের চড়া সুদের সুবিধাও নিচ্ছেন তারা। সেকেন্ডারি মার্কেটের মাধ্যমে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা এগুলোতে বিনিয়োগ করতে পারেন। কিন্তু জটিলতায় কারণে এতে বিনিয়োগের আগ্রহ নেই বললেই চলে।
২০২১ সালের ডিসেম্বরে আমানতের গড় সুদ ছিল ৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ।
গত ফেব্রুয়ারিতে তা বেড়ে হয়েছে ৫ দশমিক ০১ শতাংশ। আমানতের গড় সুদ বেড়েছে ১ শতাংশেরও কম। বিশেষ সরকারি ও ভালো ব্যাংকগুলো এখন দীর্ঘমেয়াদি আমানতে সুদ বা মুনাফা দিচ্ছে ৮ শতাংশের কম। চলতি হিসাবে কোনো মুনাফা দিচ্ছে না। সাধারণ সঞ্চয়ী হিসাবে মুনাফা দিচ্ছে ১ থেকে ৪ শতাংশ। গ্রাহকদের নিয়মের বেড়াজালে ফেলে অনেক ব্যাংক সাধারণ সঞ্চয়ী আমানত হিসাবে কোনো মুনাফাই দিচ্ছে না। ফলে এসব হিসাবে যারা সঞ্চয় করছেন তারা বলতে গেলে কোনো মুনাফাই পাচ্ছেন না। গ্রাহকরা কেবল মেয়াদি আমানতের হিসাবে সঞ্চয় করলেই মুনাফা পাচ্ছেন। প্রাপ্ত মুনাফা থেকে সার্ভিস চার্জ ও সরকারি কর কেটে রাখলে মুনাফার অংক আরও কমে যাচ্ছে। এদিকে মূল্যস্ফীতির হার সাড়ে ৯ শতাংশের উপরে রয়েছে। ফলে সব সঞ্চয়ী হিসাবেই মুনাফার সঙ্গে মূল্যস্ফীতির হার সমন্বয় করলে মুনাফা তো দূরের কথা, আসল টাকার মানই সঞ্চয়ের চেয়ে কম হচ্ছে। দুর্বল ব্যাংকগুলো বেশি মুনাফা দিলেও ঝুঁকির কারণে গ্রাহকরা এগুলোতে আমানত রাখছেন কম।
ব্যাংক খাতের মোট আমানতের ৪৪ দশমিক ৪২ শতাংশ মেয়াদি আমানত। বাকি ৫৫ দশমিক ৫৮ শতাংশই হচ্ছে চলতি, সাধারণ সঞ্চয়ী ও অন্যান্য আমানত। ফলে ব্যাংকের বেশির ভাগ আমানতকারীই মুনাফা থেকে বঞ্ছিত হচ্ছেন। ঋণের গড় সুদ ৭ দশমিক ৬১ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১০ দশমিক ০৫ শতাংশ। সর্বোচ্চ সুদ বেড়ে হয়েছে ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ। ঋণের সুদ বাড়ায় উদ্যোক্তারা চাপে পড়েছেন। কারণ তাদের ব্যবসা খরচ বেড়ে গেছে।