‘ভয়ঙ্কর’ রূপ নিচ্ছে নারায়ণগঞ্জ আ.লীগের বিভেদ
রাজু আহমেদ, নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশ: ০৮ জানুয়ারি ২০২৩, ০৮:২৪ পিএম
গত অক্টোবরে নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে এক মঞ্চে শামীম ওসমান ও সেলিনা হায়াত আইভী।
নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের শান্ত থাকা বিভেদ-কোন্দল হঠাৎ করেই অশান্ত হয়ে উঠেছে। গত ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠে থাকতে কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের বারংবার আহ্বান সত্ত্বেও সেই বিভেদ এবার ‘ভয়ঙ্কর’ রূপধারণ করতে পারে বলে আতঙ্ক প্রকাশ করেছেন সাধারণ কর্মী-সমর্থকরা। কারণ এবার কোনো ইস্যু বা কারণ ছাড়াই বিভেদের সূত্রপাত করেছেন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র সেলিনা হায়াত আইভী।
বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে গত এক বছরে মেয়র আইভীর বিরুদ্ধে তার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী সংসদ সদস্য শামীম ওসমান কোনো খোলা সমাবেশ বা দলীয় সভায় সরাসরি কিংবা পরোক্ষভাবে কোনো মন্তব্য না করলেও ওসমান পরিবারের বিরুদ্ধে আবারো সেই ‘পুরনো কাসুন্ধি’ ঘেঁটেছেন মেয়র আইভী। শুধু তাই নয়, ‘নারায়ণগঞ্জের রাজধানী কুমিল্লা’ এবং নারায়ণগঞ্জ জেলার নাম ‘ওসমান নগরী’ হয়ে যেতে পারে বলে কটাক্ষের সুরে মন্তব্য করেছেন আইভী।
শনিবার রাতে একটি গুণীজন সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে মেয়র আইভীর এমন বক্তব্যে চরম ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ কর্মীরা। তারা গণপদত্যাগের হুঁশিয়ারি দিয়ে বলছেন, কেন্দ্র জানে বিএনপি ক্ষমতায় আসলে শামীম ওসমানের ঠিকানা হবে জেলে না হয় কবরে। আর কে আরও বেশি সুখে থাকবে সেটাও কেন্দ্র জানে। সব জেনেও যখন কেন্দ্র নিশ্চুপ থাকে, তখন আমরা আর এই নোংরা খেলার খেলোয়াড় হতে চাই না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আর নেত্রীর নেতৃত্বকে বুকে ধারণ করেই প্রয়োজনে গণপদত্যাগ করব।
জানা গেছে, শনিবার রাতে ‘সাপ্তাহিক বিষের বাঁশি’ নামে একটি পত্রিকার ৩০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত গুণীজন সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্যে মেয়র আইভী বলেন, ভবিষ্যতে হয়ত এ রকম হতেও পারে- নারায়ণগঞ্জের রাজধানী কুমিল্লা হয়ে যায় কিনা। নারায়ণগঞ্জের নামটা পরিবর্তন করে ওসমান নগরী হলে ভালো হতো। এ সময় তিনি প্রশাসনের সমালোচনা করে বলেন, প্রশাসন নিজ দায়িত্ব পালন করুক এটাই চাই। কিন্তু এই নারায়ণগঞ্জ শহর থেকে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা লাখ লাখ কোটি কোটি টাকা নিয়ে গেলেও কাজ করছেন না কেন?
ওসমান পরিবারকে উদ্দেশ করে মেয়র আইভী বলেন, তাদের পূর্ব-পুরুষরা এখানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আসলে আমরা রাজার রাজত্বে নিরীহ প্রজা হয়ে আছি। ৩০ বছর ধরেই এই শহরকে জিম্মি করে রেখেছেন। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে প্রজারা এই রাজার অত্যাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। আমরা কোনো রাজার রাজত্ব চাই না। আপনাদের রাজত্ব মেনে নেই নাই। মেনেও নেব না।
এদিকে মেয়র আইভীর এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাদের মধ্যে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। নারায়ণগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি চন্দন শীল যুগান্তরকে বলেন, বেগম খালেদা জিয়া যে ক্ষোভ থেকে গোপালগঞ্জের নাম পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন, ঠিক একই ক্ষোভ থেকে মেয়র আইভীও নারায়ণগঞ্জের নাম বদলের কথা বলেছেন। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনের আগে মেয়র আইভীর এমন বক্তব্য ইঙ্গিত করছে, এটার নেপথ্যের কোনো মিশনের সবেমাত্র শুরু। কারণ নারায়ণগঞ্জ বিএনপির নেতৃত্বে যিনি এসেছেন তার কারণে ২০০১ সালের পর শামীম ওসমানের নির্বাচনি এলাকা ফতুল্লা-সিদ্ধিরগঞ্জে কোনো আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী বাড়িতে ঘুমাতে পারেনি, তিনি বহু আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যা করেছেন এবং সর্বোপরি তিনি মেয়র আইভীর ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। বাকিটা দলের সভানেত্রী আছেন তিনি অবশ্যই সব কিছুই জানেন।
নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু হাসনাত শহীদ বাদল যুগান্তরকে বলেন, মেয়র আইভী বিএনপিকে খুশি করতে এমন বক্তব্য দিয়ে থাকলেও বিএনপি কতটা খুশি হবে সেটা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ বিএনপি বিগত সময় থেকে এ পর্যন্ত মেয়র আইভীর কার্যকলাপে তাকে অবশ্যই চিনে ফেলেছে বলে আমি বিশ্বাস করি। কারণ তিনি বিএনপির, জামায়াতের, সুশীলদের নাকি আওয়ামী লীগের- সেটা নিয়েই সন্দেহ আছে। তবে নতুন করে তার এমন বক্তব্য দলের ক্ষুব্ধ ও উত্তেজিত নেতাকর্মীদের শান্ত করা কষ্টকর হয়ে যাবে বলে আমি মনে করি।
নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খোকন সাহা যুগান্তরকে বলেন, কয়েক দিন আগেই আমাদের দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘দলের ভেতরই ষড়যন্ত্র চলছে, এরা দলের ভেতর ঘাপটি মেরে বসে অপকর্ম করে’। আমার মতো হাজার হাজার কর্মীরাও সেই ষড়যন্ত্রের গন্ধই পাচ্ছেন। শামীম ওসমান বা তার ঐতিহ্যবাহী পরিবারের বিরুদ্ধে বিএনপি-জামায়াতের অন্তরে পুষে রাখা বক্তব্য মেয়র আইভীর মুখ থেকেই বের হয়, এটা নতুন কিছু নয়। কিন্তু সবকিছুরই সীমা-পরিসীমা আছে। নিজের নির্বাচন এলে শামীম ওসমানকে বড় ভাই বলেন আর নির্বাচন শেষে গালাগাল করবেন, কর্মীদের মূল্যায়ন তো দূরে থাকুক একটা সভা-সমাবেশ পর্যন্ত দলের জন্য করবেন না, বিএনপি-জামায়াত কিংবা দেশের বিরুদ্ধে যেসব সুশীলরা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত তাদের বিরুদ্ধে কথা বলবেন না। আমরা দলের বাইরের শত্রুর সঙ্গে লড়ব না ঘরের শত্রুর সঙ্গে- এভাবে যুদ্ধ করা যায় না।
এদিকে দলের (ফতুল্লা, সিদ্ধিরগঞ্জ, নগর, বন্দর) তৃণমূল কর্মীদের সঙ্গে কথা বললে তারা উলটো শামীম ওসমানের প্রতি ভালোবাসার অভিমান প্রকাশ করে বলেন, তাকে আমাদের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বিশেষ স্নেহ করেন, তার পরিবারের প্রতিও গভীর ভালোবাসা আছে। শামীম ওসমানও সব সময় বলেন তিনি শেখ হাসিনার ‘ওয়ান মাস্টার ডগ’। তার নির্দেশে যার জন্য আমরা প্রতিবার নাসিক নির্বাচনে মাঠে নামি, সেই নেত্রীই যখন তাকে ও তার পরিবার নিয়ে আপত্তিকর কথা বলেন তখন বিএনপির কর্মীরা আমাদের নিয়ে হাসাহাসি করেন। তিনি যদি এভাবে আমাদের মাঠে নামিয়ে বারবার ছোট করেন তবে আমরাও আর দল করব না।