কোটায় ভর্তিতে নানা অনিয়মের অভিযোগ
উচ্চশিক্ষায় ভর্তিতে ছয় ধরনের কোটা বহাল
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা রয়েছে ৫ শতাংশ
দেশের সরকারি উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে এখনো ছয় ধরনের কোটা বহাল রয়েছে। এতে সবচেয়ে বেশি কোটা রয়েছে মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনিদের ভর্তির ক্ষেত্রে। চলতি বছর জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন শুরু হয় কোটা বাতিল নিয়ে। এ আন্দোলনে একপর্যায়ে শেখ হাসিনা সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। সম্প্রতি পোষ্য ও মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের দাবি জানিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এছাড়া কোটায় ভর্তিতে রয়েছে নানা অনিয়মের অভিযোগ। বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় একটি আসনের বিপরীতে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এমনকি জিপিএ-৫ পেয়ে অনেক শিক্ষার্থী ভালো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পান না। আসন সংকট ও ভর্তির তুমুল প্রতিযোগিতার মাঝেও কোটাব্যবস্থার কারণে অনেক অযোগ্য শিক্ষার্থীও ভর্তি হয়ে যান। এতে একধরনের বৈষম্য তৈরি হয়। ফলে উচ্চশিক্ষায় ভর্তিতে কোটায় যৌক্তিক সংস্কার আনা উচিত-এমন অভিমত সংশ্লিষ্টদের।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন ধরনের কোটার সুবিধা দেওয়ার ক্ষেত্রে নতুন করে ভাবা দরকার। জুলাইয়ের বিপ্লবের পর চাকরির ক্ষেত্রে কোটা সংস্কার হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে কোটা রয়েই গেছে। আগামী শিক্ষাবর্ষের ভর্তির ক্ষেত্রে যৌক্তিকভাবে কোটা বাতিল বা সংস্কার আনা উচিত। বিশেষ করে নির্ধারিত কোটাগুলোর স্পষ্ট ও বিস্তারিত সংজ্ঞায়ন জরুরি, যাতে কোনোরকম অনিয়মের সুযোগ না থাকে। ভর্তি পরীক্ষার ন্যূনতম পাশ নম্বর ছাড়া কোনো শিক্ষার্থীকে কোটার সুবিধা দেওয়া ঠিক হবে না। এটিও বিবেচনায় রাখা উচিত।
জানা যায়, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির জন্য যে ছয় ধরনের কোটা রয়েছে সেগুলো হলো-ওয়ার্ড বা পোষ্য কোটা, উপজাতি বা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী কোটা, হরিজন ও দলিত সম্প্রদায় কোটা, প্রতিবন্ধী কোটা, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান বা মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনি কোটা এবং খেলোয়াড় কোটা। এতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা সবচেয়ে বেশি ৫ শতাংশ। এছাড়া পোষ্য ও খেলোয়াড় কোটা নির্দিষ্ট করা নেই। বাকিগুলোয় ১ শতাংশ কোটা রয়েছে। তবে কোটায় পাশ করলেই ভর্তির সুযোগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটাপ্রথা বহাল রয়েছে। ছয়টি কোটার মধ্যে নতুন করে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে খেলোয়াড় কোটা। খেলোয়াড় কোটায় আবেদন করার জন্য বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (বিকেএসপি) থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ইউনিটভিত্তিক ন্যূনতম জিপিএ থাকতে হয়। নিয়ম না মেনেই এ কোটায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয়। এছাড়া স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিচালনাসংক্রান্ত ১৯৭৩-এর অধ্যাদেশে ভর্তির বিষয়ে কোটাসংক্রান্ত সুযোগ-সুবিধার স্পষ্ট উল্লেখ নেই। তবে ভর্তির বিষয়ে কমিটিকে ক্ষমতা দিয়ে অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব ভর্তি কার্যক্রম অধ্যাদেশের ৪৬ ধারা অনুযায়ী ভর্তি কমিটি দ্বারা নির্ধারিত কার্যপ্রণালি অনুসরণ করতে হবে। ধারণা করা হয়, এ ধারাকে সুযোগ হিসাবে কাজে লাগিয়েই ভর্তি পরীক্ষায় কোটা পদ্ধতি চালু করা হয়।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ে মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক এসএমএ ফায়েজ যুগান্তরকে বলেন, কোটা সংস্কার নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। কমিশনের সদস্যদের সঙ্গে আমরা এ বিষয়ে আলাপ করব। তবে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজস্ব পদ্ধতিতে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। এছাড়া অনেক সময় কোটায় ভর্তিতে নানা অনিয়ম হয়ে থাকে। খেলাধুলা করে না-এমন অনেকে খেলোয়াড় কোটায় ভর্তি হয়ে যান। প্রতিবন্ধী ও উপজাতি কোটা বাদ দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক কামরুল আহসান যুগান্তরকে বলেন, আগামী শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির ক্ষেত্রে কোটা বিষয়ে আমরা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিব। এক্ষেত্রে মেধাকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে। কোটায় বৈষম্যহীনভাবে একটি যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানান তিনি। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাউবি) উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. দিল রওশন জিন্নাত আরা নাজনীন যুগান্তরকে বলেন, উপজাতি বা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী কোটা, হরিজন ও দলিত সম্প্রদায় কোটা এবং প্রতিবন্ধী কোটা ছাড়া বাকিগুলো বাদ দেওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। এসব কোটার কারণে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষায় ভর্তিতে বঞ্চিত হন। জানা যায়, সম্প্রতি ঢাবিতে ডিনস কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ শিক্ষাবর্ষের আন্ডার গ্র্যাজুয়েট কোর্সের ভর্তি পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছে। সেই সুপারিশে আগের মতোই ছয় ধরনের কোটা বহাল রাখা হয়েছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ভর্তি কমিটির সভায় মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে বিতর্ক হয়।
কোনো কোনো সদস্য মুক্তিযোদ্ধা কোটা একেবারে বাতিল অথবা শুধু সন্তানদের জন্য ১ শতাংশ কোটা রাখার পক্ষে মত দেন; তারা নাতি-নাতনিদের জন্য কোটা পুরোপুরি বাদ দিতে বলেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একাডেমিক কাউন্সিলের সভায়ও এ নিয়ে আলোচনা হবে। তবে সংস্কার হলেও এ বছর থেকেই পরিবর্তন হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
বিগত বছরগুলোয় বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পোষ্য কোটায় ভর্তির ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতির কথা উঠেছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পোষ্য কোটায় ভর্তিবিষয়ক জটিলতা নিয়ে তুমুল সমালোচনা হয়েছিল। পোষ্য কোটায় সুবিধা পান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছেলেমেয়ে এবং স্বামী-স্ত্রী। অবসরে যাওয়ার এক বছর পরও এ সুযোগ পেয়ে থাকেন তারা। এ সুবিধার জন্য আবেদন করেন বিশ্ববিদ্যালয়টির পরিচ্ছন্নতাকর্মী, মালী থেকে শুরু করে জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকরাও। এক্ষেত্রে ভর্তির নির্দিষ্ট কোনো আসনও নেই। পোষ্য কোটায় অনিয়মের সুযোগ থাকে এবং বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারতন্ত্রের কবলে পড়েছে বলেও মনে করেন কেউ কেউ।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তির ক্ষেত্রে একটি আসনের বিপরীতে অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থী প্রতিযোগিতা করেন। এসএসসি ও এইচএসসিতে ভালো ফল করেও অনেকেই এ ভর্তিযুদ্ধে হেরে যান। এতে মেধাবীদের বঞ্চিত করে কোটায় কিছু শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকছে। এখন সময় এসেছে কোটা নামে বৈষম্য দূর করা।
এদিকে বৃহস্পতিবার পোষ্য কোটা ও মুক্তিযোদ্ধার নাতি-নাতনি কোটা বাতিল চেয়ে উপাচার্যের কাছে স্মারকলিপি দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। স্মারকলিপিতে বলা হয়েছে, আমরা বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যের শিকার হয়েছি, যার মধ্যে অন্যতম অযৌক্তিক কোটা পদ্ধতি। এ কোটা বৈষম্যের প্রতিবাদেই বিগত জুলাই বিপ্লবের ইতিহাস রচিত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের এই স্বাধীন ক্যাম্পাসে আর কোনো ধরনের অযৌক্তিক কোটা পদ্ধতি দেখতে চাই না। বিগত ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষে ৫৩৪ জন, ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ৫৩৭ জন এবং ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ৬২১ জন শিক্ষার্থী কোটার মাধ্যমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। যার একটি বড় অংশ অযৌক্তিক পোষ্য কোটা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-নাতনি কোটা। আমরা এ দুটি অযৌক্তিক কোটা অবিলম্বে বাতিলের দাবি জানাই।