সেই শিশুসহ আরও ৪ লাশ হস্তান্তর
শনাক্তের পরও মিনহাজের লাশ পেতে ভোগান্তি
ইমন রহমান
প্রকাশ: ০৩ মার্চ ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
পুরো শরীর কয়লা হলেও হাতের ঘড়ি ও উঁচু দাঁত দেখে মিনহাজ উদ্দিনের (২৬) লাশ শনাক্ত করেন তার ভাই আমিনুল ইসলাম। শুক্রবার সকালে লাশ শনাক্ত করলেও হস্তান্তরে দেখা দেয় জটিলতা।
ঘটনার পর থেকে নিখোঁজ ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নাজমুল হোসেনের (২৬) স্বজনরা লাশ হস্তান্তরে আপত্তি জানান। তাদের দাবি, অঙ্গার হওয়া দুটি লাশের মধ্যে যে কোনো একটি নাজমুলের। ফলে ডিএনএ নমুনা পরীক্ষার পরই লাশ হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু নাজমুলের পরিবারকে ম্যানেজ করে ময়নাতদন্ত শেষে শনিবার সন্ধ্যায় লাশ বুঝে নেন মিনহাজের স্বজনরা। পরিচয় শনাক্তের পর এদিন ‘অজ্ঞাতপরিচয় হিসাবে মর্গে পড়ে থাকা’ সেই ছোট্ট শিশু ও তার মা-বাবার লাশও পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
শনিবার সকাল থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গের সামনে জড়ো হন মিনহাজের স্বজনরা। তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, লাশ শনাক্তের পরও আমাদের হয়রানি করা হয়।
মিনহাজের ভাই আমিনুল যুগান্তরকে বলেন, হাতের ঘড়ি, উঁচু দাত ও পেটে সার্জারির চিহ্ন দেখে আমরা মিনহাজের লাশ শনাক্ত করি। শুক্রবার থেকে আমরা মর্গে অবস্থান করছি। কিন্তু নাজমুল নামের এক ব্যক্তির স্বজনরা আপত্তি জানানোয় লাশ হস্তান্তরে জটিলতার সৃষ্টি হয়। পরে তাদের অনুরোধ করে আমরা লাশ বুঝে পেয়েছি।
রাজধানীর ইসলামপুরের গাছতলা এলাকায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন মিনহাজ। তার গ্রামের বাড়ি চাঁদপুর মতলব উত্তরে। ড্যাফডিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়ালেখা শেষ করে একটি সফটওয়্যার ফার্মে চাকরি করতেন তিনি। তিন ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট মিনহাজ।
ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) উৎপল বড়ুয়া যুগান্তরকে বলেন, হাতের ঘড়ি দেখে মিনহাজের লাশ স্বজনরা চিহ্নিত করেন। কিন্তু অন্য একটি পরিবার লাশের দাবিদার হওয়ায় কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়। পরে দুই পরিবারের সম্মতিতেই শনিবার স্বজনদের কাছে মিনহাজের লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। তবে তারও ডিএনএ নমুনা পরীক্ষা করা হবে।
তিনি আরও বলেন, শনিবার মোট চারটি লাশ হস্তান্তর করা হয়েছে। এখনো দুটি লাশ মর্গে আছে, ডিএনএ পরীক্ষার পরই সেগুলো হস্তান্তর করা হবে।
বৃহস্পতিবার রাতে বেইলি রোডে গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে আগুনের ঘটনায় ৪৬ জন নিহত হন। তাদের মধ্যে ৪০ জনের লাশ শুক্রবারই হস্তান্তর করা হয়। শনিবার হস্তান্তর করা হয় চারটি লাশ। তাদের মধ্যে মিনহাজ ছাড়া অন্যরা হলেন কক্সবাজারের উখিয়া পূর্ব গোয়ালিয়া গ্রামের বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. আবুল কাশেমের ছেলে সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা শাহজালাল উদ্দিন (৩৪), তার স্ত্রী মেহেরুন নেসা হেলালী (২৪) ও তাদের মেয়ে ফাইরুজ কাশেম জামিলা (৪)। এর আগে মর্গে শিশু ফাইরুজ কাশেম জামিলার লাশ পড়েছিল অজ্ঞাতপরিচয় হিসাবে। হাসপাতালের একটি ফর্মে তার বুকের ওপর লেখা ছিল-অজ্ঞাতপরিচয়, বয়স ৫ বছর। মাথার চুলে ছিল দুটি ঝুঁটি, পায়ে মোজা। প্রিন্টের একটি গেঞ্জি ও প্যান্ট পরা শিশুটির শরীরে কোনো পোড়া দাগ ছিল না। তবে নাকে-মুখে কালচে চিহ্ন ছিল। পরিচয় জানা হলে ৩১ ঘণ্টা পর মা-বাবার লাশের সঙ্গে তার লাশও হস্তান্তর করা হয়।
পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, শুক্রবার রাত সাড়ে ৯টায় মেহেরুনের বাবা ইঞ্জিনিয়ার মোক্তার হোসেন হেলালী ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গে গিয়ে মেয়ে, জামাতা ও নাতনির পোশাক দেখে লাশ শনাক্ত করেন। শনিবার সকালে ময়নাতদন্ত ছাড়াই তাদের লাশ হস্তান্তর করে ঢাকা জেলা প্রশাসন। ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট একেএম হেদায়েতুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, মর্গে থাকা বাকি দুটি লাশের ডিএনএ পরীক্ষার পরই হস্তান্তর করা হবে।
মর্গে থাকা একটি লাশ রাজধানীর রামপুরার বনশ্রীর বাসিন্দা নজরুল ইসলামের ছেলে নাজমুল হোসেনের বলে দাবি করছে পরিবার। শনিবার ঢামেক মর্গে লাশটির ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে।
নাজমুলের মামা মো. হোসেন বলেন, চার বন্ধু মিলে রাতে ডিনার করতে গিয়েছিল নাজমুল। ভবনে আগুন লাগার পর সে মোবাইল ফোনে একবার তার মায়ের সঙ্গে কথাও বলেছিল। পরে আর কোনো খোঁজ না পেয়ে হাসপাতাল মর্গে আসি আমরা। কিন্তু নাজমুলকে পাইনি। পুড়ে অঙ্গার হওয়া দুটি লাশের একটি নাজমুলের-এমন ধারণা করছি।
মিনহাজের লাশ হস্তান্তরের বিষয়ে হোসেন বলেন, মিনহাজের পরিবার শনাক্তের দাবি করায় আমরা আর অপত্তি করিনি। তারও ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করেছে পুলিশ। পরে মিলিয়ে দেখা হবে বলে আমাদের জানানো হয়েছে।
টিকিট কেটেও বাড়ি ফিরতে পারলেন না শাহজালাল: কক্সবাজার প্রতিনিধি জানান, মৃত সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা শাহজালাল উদ্দিন উখিয়ার হলদিয়াপালং ইউনিয়নের বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. আবুল কাশেমের মেজ ছেলে। তারা পাঁচ ভাই, এক বোন।
শাহজালালের শ্বশুর মোক্তার হোসেন বলেন, আমার মেয়ের জামাই দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের পোর্টে কাস্টম ইন্সপেক্টর হিসাবে কর্মরত ছিলেন। দুদিনের ছুটি নিয়ে গ্রামের বাড়ি কক্সবাজার যাওয়ার জন্য ঢাকায় আসেন। গ্রিনলাইন বাসের টিকিটও কাটেন তিনি। ঢাকায় আসার পর পরিবার নিয়ে কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলেন। এরপর আমার মেয়ে, জামাতা ও নাতনি লাশ হয়ে ফিরে।
হলদিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ইমরুল কায়েস চৌধুরী বলেন, পৃথিবীতে আসার সিরিয়াল আছে কিন্তু যাওয়ার সিরিয়াল নেই-তা প্রমাণ করলেন শাহজালাল। তার মা-বাবা ও বড় ভাই এখনো বেঁচে আছেন। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে স্ত্রী, সন্তানসহ পৃথিবী ছেড়ে চলে গেলেন তিনি।