একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন জরুরি: অধ্যাপক ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
এম এ খালেক
প্রকাশ: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন জরুরি: অধ্যাপক ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2025/02/12/59-67ac2bd39609e.jpg)
বীর মুক্তিযোদ্ধা ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪২ বছর শিক্ষকতা করেছেন। এ সময় তিনি উপাচার্যের দায়িত্বসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া ২০০৩ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত বাহরাইনে বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রদূত হিসাবে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি এখনো শিক্ষা বিস্তারের জন্য কাজ করে চলেছেন। সমাজবিজ্ঞান ও নৃবিজ্ঞান বিষয়ে তার প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ২০ এবং দেশে-বিদেশে তার ৫০টির বেশি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একজন শিক্ষা গবেষক হিসাবে পরিচিত। যুগান্তরের জন্য তার সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এ খালেক
যুগান্তর : বর্তমানে দেশে শিক্ষার যে মান বিরাজ করছে, সেটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী : দেশের শিক্ষার সামগ্রিক মান সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয়, শিক্ষার মান একেবারেই অবনতিশীল রয়েছে। শিক্ষার মানের এতটাই অবনতি হয়েছে যে, তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। ষাটের দশকে আমাদের এ অঞ্চলে শিক্ষার যে মান ছিল, স্বাধীনতার পর তার ধীরে ধীরে অবনতি হতে থাকে। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, আমরা যেসব গ্র্যাজুয়েটস তৈরি করছি, তারা কার্যত অর্ধশিক্ষিত গ্র্যাজুয়েটস। এদের অধিকাংশকেই সুশিক্ষিত গ্র্যাজুয়েটস বলা যাবে না। শিক্ষার্থীদের জ্ঞান আহরণ এবং জ্ঞানচর্চা বলতে আমরা যেটা বুঝি তা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে, যে কারণে শিক্ষার এ নিম্নমান পরিলক্ষিত হচ্ছে। আমি অভিজ্ঞতার আলোকে এর দুটি কারণ চিহ্নিত করতে পেরেছি। প্রথমত, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর জাতীয় সিদ্ধান্ত ছিল বাংলায় উচ্চশিক্ষা প্রদান করা হবে।
বাংলা ভাষায় প্রয়োজনীয়সংখ্যক গ্রন্থ রচনা করা এবং বিদেশি বই বাংলায় অনুবাদ করার জন্য বাংলা একাডেমিকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। কিন্তু বাংলা একাডেমি সেই দায়িত্ব পালনে প্রায় ব্যর্থ হয়েছে বলা যেতে পারে। আমরা যারা শিক্ষক-গবেষক, তারাও চাহিদা পূরণের মতো প্রচুর পরিমাণে গ্রন্থ রচনা করতে পারিনি। ফলে শিক্ষার্থীদের বিদেশি ভাষায় লিখিত বই, বিশেষ করে ইংরেজি ভাষায় লেখা বইয়ের ওপর নির্ভর করতে হয়েছে। দুঃখের বিষয় হচ্ছে, ইংরেজি ভাষায় লেখা বই পড়ে অধিকাংশ শিক্ষার্থীই তা সঠিকভাবে আত্মস্থ করতে পারছে না। ফলে জ্ঞানের যে প্রবাহ তা কার্যত বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ জ্ঞানটা বই থেকে পাওয়া সম্ভব। আর পাওয়া সম্ভব ক্লাসরুমে শিক্ষকের বক্তব্য থেকে। কিন্তু একজন শিক্ষার্থী যদি বই পড়ে বুঝতে না পারে, তাহলে জ্ঞান আহরণ করবে কোত্থেকে?
দ্বিতীয়ত, বাংলা ভাষায় যদি বিকল্প পথে জ্ঞান আহরণের ব্যবস্থা থাকত, অর্থাৎ বাংলা ভাষায় পর্যাপ্ত পরিমাণ বই পাওয়া যেত, তাহলে শিক্ষার্থীরা সেখান থেকে প্রয়োজনীয় জ্ঞান আহরণ করতে পারত। মাতৃভাষা জ্ঞান আহরণের সবচেয়ে সহজ ও কার্যকর পন্থা হিসাবে বিবেচিত হতে পারে, যদি প্রয়োজনীয় উপকরণ অর্থাৎ বই পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা সেই চাহিদা পূরণ করতে পারিনি। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত যাদের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তাদের বেশিরভাগই অত্যন্ত নিম্নমানের। তাদের মধ্যে এমন ব্যক্তিও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পেয়েছেন, যার শিক্ষক হওয়ার মতো ন্যূনতম যোগ্যতা ছিল না। প্রধানত দলীয় আনুগত্যের বিবেচনায় এরা শিক্ষক হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন। অবশ্য সব শিক্ষকই যে একই শ্রেণির তা নয়। তাদের মধ্যে কিছু ভালো শিক্ষক আছেন, যারা নিয়মিত পড়াশোনা করেন, গবেষণা করেন। কিন্তু একটি বিরাটসংখ্যক শিক্ষক আছেন, যাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অযোগ্য যেসব ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ লাভ করেন, তাদের মূল উদ্দেশ্য শিক্ষার মানোন্নয়ন নয়, তাদের উদ্দেশ্য থাকে কীভাবে মহলবিশেষের সন্তুষ্টি অর্জন করে চাকরি টিকিয়ে রাখা যায়। গত ১৫ বছরে এ প্রবণতা মুখ্য হয়ে উঠেছিল।
যুগান্তর : দলীয় আনুগত্যের বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগদান শিক্ষা খাতের জন্য কতটা ক্ষতিকর বলে মনে করেন?
ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী : শিক্ষকতার মতো মহান পেশায় কোনোভাবেই দলীয় বিবেচনায় অযোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া উচিত নয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে আমরা দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করেছি, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় আনুগত্যের বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে গত সাড়ে ১৫ বছরে দলীয় আনুগত্যের বিবেচনায় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। মেধা ও যোগ্যতার কোনো মূল্যায়ন করা হয়নি। ফলে শিক্ষক হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্তির পর তারা জ্ঞানচর্চার পরিবর্তে দলবাজি করেছেন। কিভাবে শাসকগোষ্ঠীকে তুষ্ট করা যায় সেই চেষ্টা করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক দেশের সর্বোচ্চ সম্মানিত ব্যক্তি। সেই তিনি যদি দলবাজি করেন, তাহলে শিক্ষার মান্নোনয়ন হবে কিভাবে? বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন শিক্ষকও আছেন, যারা তাদের অবস্থান টিকিয়ে রাখার জন্য ছাত্রদের ব্যবহার করেছেন। তারা সন্ত্রাসী কার্যক্রম দেখেও না দেখার ভান করেছেন। দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাস জেঁকে বসেছিল। এ ধরনের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ শিক্ষার পরিবেশকে নষ্ট করেছে। দলবাজ শিক্ষক সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের সন্ত্রাসকে আমলে নিয়ে তা দমনের কোনো ব্যবস্থা করেননি। কারণ তারা মনে করতেন, সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের নেতাদের সন্ত্রাসী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে তাদের অবস্থান ঠিক থাকবে না। এ সুযোগ নিয়ে সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠনের একশ্রেণির নেতাকর্মী ব্যাপক চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়ে।
আমরা এদের কারণে শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত শিক্ষা দিতে পারিনি। জাতির প্রত্যাশামতো মানসম্মত শিক্ষা প্রদানে আমরা ব্যর্থ হয়েছি। একজন শিক্ষক সর্বজনীন মর্যাদাপ্রাপ্তির দাবিদার; কিন্তু ব্যাপকভিত্তিক দলীয়করণ, চাটুকারিতা এবং দলবাজির কারণে শিক্ষকদের মর্যাদা নষ্ট হয়েছে। আগস্ট আন্দোলনের পর দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষকদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। শিক্ষকদের লাঞ্ছিত করা হয়েছে। এটা খুবই দুঃখজনক। একজন শিক্ষকের প্রতি এ ধরনের আচরণ মোটেও কাম্য হতে পারে না। কিন্তু কিছু শিক্ষকের অতিমাত্রায় রাজনৈতিক দলের প্রতি আনুগত্যের কারণে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা তাদের অসম্মান করেছে। একজন শিক্ষক হিসাবে আমি এ ধরনের অসৌজন্যমূলক আচরণের নিন্দা জানাই। একজন শিক্ষক সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতি তার আনুগত্য প্রদর্শন করা ঠিক নয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, কোনো কোনো শিক্ষকের আচরণ দেখে মনে হয় তিনি শিক্ষক নন, রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মী। এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। একটা সময় পর্যন্ত শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে যোগ্যতাকে প্রাধান্য দেওয়া হতো। তখন শিক্ষার মান এতটা নিম্নগামী ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সর্বোচ্চ ব্যক্তি হচ্ছেন উপাচার্য। এখন সেসব শিক্ষককেই উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া হয়, যারা সরকারের প্রতি প্রশ্নাতীত আনুগত্য প্রদর্শন করতে পারেন। এমনও শোনা যায়, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী নির্ধারিত অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ দিতেন। এ অভিযোগ যদি সত্যি হয়, তাহলে এর চেয়ে দুঃখজনক আর কী হতে পারে? নিশ্চয়ই কোনো যোগ্য ও উপযুক্ত ব্যক্তি অর্থের বিনিময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হতে চাইবেন না। কিন্তু এমন একজন ব্যক্তিকেই উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া উচিত, যিনি একজন শিক্ষাবিদ, একজন গবেষক এবং সবসময় জ্ঞানচর্চায় নিয়োজিত রয়েছেন। তাহলে তিনিই শিক্ষার্থীদের চাহিদা বুঝতে পারবেন। তাদের উপযুক্ত নাগরিক হিসাবে গড়ে তোলার ব্যবস্থা করতে পারবেন। যে কোনো পরিস্থিতিতে সত্য বলতে পারবেন। কিন্তু এসব না করে যিনি শুধু দলবাজি করেন তাকে উপাচার্য নিয়োগ দিলে তিনি কিভাবে শিক্ষার্থীদের উন্নয়নে কাজ করবেন?
গত সাড়ে ১৫ বছর দেশে কোনো গণতন্ত্র ছিল না। মানুষ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। কিন্তু কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে কি বলতে শুনেছেন, সরকারকে বলেছেন, দেশে গণতন্ত্র কায়েম করেন; মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেন? তা না করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা সরকারের অযৌক্তিক প্রশংসায় নিয়োজিত থেকেছেন। সরকারপ্রধান যে ভাষায় কথা বলতেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরাও সেই একই ভাষায় কথা বলতেন। তাদের এ প্রশংসাসূচক বক্তব্য শ্রবণ করে সরকার মনে করত, তাদের মতো ভালো কাজ আর কেউ করতে পারেনি। তারাই উন্নয়নের রোল মডেল। কিন্তু গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানুষের মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ন করে যে উন্নয়ন, তা কখনোই প্রকৃত উন্নয়ন হতে পারে না। কিন্তু ১৯৭১ সালে আমরা কী দেখেছি? বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক পাকিস্তানি শাসকচক্রের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। কেউ কেউ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে শহিদ হয়েছেন, কিন্তু তারপরও তারা ন্যায়ের পথচ্যুৎ হননি।
যুগান্তর : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদানের কথা শোনা যাচ্ছে। কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট বিক্রি থেকে শুরু করে নানা অভিযোগ শোনা যায়। এ অবস্থায় এই উদ্যোগকে একজন শিক্ষাবিদ হিসাবে আপনি কীভাবে দেখছেন?
ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী : আমি ব্যক্তিগতভাবে এ উদ্যোগকে মোটেও সমর্থন করি না। অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার মান ভালো নয়। কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি বিক্রি হয়। অর্থ খরচ করলে সার্টিফিকেট কিনতে পাওয়া যায়। কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান ভালো হলেও বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে নেই। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যাদের মালিকানায় গড়ে উঠেছে, তাদের অধিকাংশই ব্যবসায়ী। তারা বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান হিসাবে মনে করেন। এতে উচ্চশিক্ষার বাণিজ্যিকরণ হয়েছে। উচ্চবিত্ত শ্রেণির পরিবারের ছেলেমেয়েরাই মূলত এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকদের অনেকেই মনে করেন, গার্মেন্টস শিল্প যেমন একটি প্রকল্প, ঠিক তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ও একটি বাণিজ্যিক প্রকল্প বৈ আর কিছু নয়।
যুগান্তর : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট যদি একটু বলতেন।
ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী : মহতী উদ্দেশ্য নিয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। ১৯৯২ সালে যে আইনের অধীনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেই আইন ছিল অত্যন্ত যৌক্তিক ও সময়োপযোগী। সেই সময় বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী পাশ করার পরও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেত না। সে সময় আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ছিলাম। আমরা একটি শিক্ষক প্রতিনিধিদল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরি। আমরা বেগম খালেদা জিয়াকে জানাই, দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর অনেকেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পান না আসন স্বল্পতার কারণে। অনেক শিক্ষার্থী দেশের কোনো ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে না পেরে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত এবং অন্যান্য দেশে চলে যায়। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আমাদের বক্তব্য শুনে খুবই ব্যথিত হলেন। তিনি বললেন, এত বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী লেখাপড়ার জন্য বিদেশে চলে যাচ্ছে, এটা রোধ করার জন্য আপনারা আরও বেশি বেশি করে শিক্ষার্থী ভর্তির ব্যবস্থা করেন। আমরা তাকে জানাই, বিশ্ববিদ্যালয়ে এভাবে শিক্ষার্থী ভর্তি করা যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন সংখ্যা সীমিত রাখতে হবে। আমরা তাকে বেসরকারি খাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমতি প্রদানের জন্য অনুরোধ জানাই। আমাদের কথা শুনে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বেশ আগ্রহ প্রদর্শন করলেন। পরবর্তীকালে এ সংক্রান্ত আইনের খসড়া প্রণয়ন করে তা জাতীয় সংসদে পাশ করার ব্যবস্থা করা হয়। আমি ব্যক্তিগতভাবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা সংক্রান্ত আইনের খসড়া প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। আইন পাশ হওয়ার পর ৪/৫টি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় বেসরকারি উদ্যোগে। এগুলো বেশ ভালো মানের বিশ্ববিদ্যালয় হিসাবে পরিচিতি লাভ করে। কিন্তু পরবর্তীকালে রাজনৈতিক বিবেচনায় বেসরকারি খাতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার অনুমতি দেওয়ার ফলে ব্যাঙের ছাতার মতো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে। এ সুযোগে এমন সব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়, যাদের লেখাপড়ার মান নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় অর্থের বিনিময়ে সার্টিফিকেট বিক্রি করতে শুরু করে।
যুগান্তর : বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন হচ্ছে না। এটা কি গণতন্ত্রচর্চার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক বলে মনে করেন?
ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী : এটা দুর্ভাগ্যজনক যে, বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত সময়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারেনি। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কেন ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে পারেনি, তার অনেক কারণ আছে। তবে প্রধান কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক। যে সময় যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে, তারা যদি মনে করে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিলে তাদের সমর্থিত ছাত্র সংগঠন নির্বাচনে হেরে যাবে, তাহলে নির্বাচন দেয় না। নির্বাচিত ছাত্র সংসদ না থাকার কারণে ছাত্ররা তাদের বিভিন্ন দাবি-দাওয়া কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরতে পারছে না। ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গড়ে উঠছে না।
যুগান্তর : বিদ্যমান পরিস্থিতিতে নতুন শিক্ষানীতি প্রয়োজন বলে মনে করেন কি?
ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী : বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বেশ কয়েকটি শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছে। কিন্তু সেসব শিক্ষানীতির কোনোটিই বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আমলে একটি যুগোপযোগী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা খুবই জরুরি।
যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. আনোয়ারউল্লাহ চৌধুরী : ধন্যবাদ।